পরদিন ভজুদার কাছে কথাটা তুলোম, ভজুদা, রাতে রোজ ঠক ঠক শব্দ শুনি।
ভজুদা চোখ পাকিয়ে বললেন, ভূতে বিশ্বাস আছে নাকি?
-না না, ভূত না, কিন্তু কিছু হয়তো তৈরি হচ্ছে ওখানে।
–কোথায়?
–ওই ছাপাখানার পিছনে, নতুন ঠান্ডাঘরে।
–ও তো এখনও শেষই হয়নি। সব বিষয়ে যুক্তি দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করবে।
–না ভজুদা, ভিতরটা হয়ে গেছে, শুধু সামনের দিকটাই চার বছর ধরে তৈরি হচ্ছে। গুপি বলে–।
ভজুদা বললেন, লেখো, একটা বাঁদর একটা তেলতেলা বাঁশ বেয়ে এক মিনিটে কী হল?
–ভজুদা, বড়ো মাস্টারমশাই নাকি ভূত দেখেছেন। এখানে সব্বাই ভূতের ভয় পায়। সন্ধ্যার পর কেউ ঘাটের গলির দিকে যাবে না। রেলের লাইনে পা দেবে না। রামকানাই বলেছে রাতে ও-লাইনে যেসব গাড়ি আসে, তারা কোনো মালগুদোম থেকে আসে না।
ভজুদা বিরক্ত হয়ে উঠলেন, তাহলে কি বুঝতে হবে যে শুধু মানুষগুলো মলেই ভূত হয় না, রেলগাড়িদেরও ভূত হয়? নাও, চটপট অঙ্কটা টুকে ফেলো। তা ছাড়া একটু হাঁটাচলা করতে অভ্যাস করো এবার। যত সব আজগুবি চিন্তা! ভূতফুত নেই। এক্সারসাইজ করলেই টের পাবে।
অঙ্ক কষা হয়ে গেলে বললাম, আচ্ছা, ভূত না থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে যে কেউ লুকিয়ে স্পেসশিপ বানাবে না, তাই-বা কী করে বলা যায়?
ভজুদা অবাক হয়ে আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, এ বিষয়ে কয়েকটা বৈজ্ঞানিক বই এনে দেব। তাহলেই বুঝবে যে স্পেসশিপ চাট্টিখানিক কথা নয় যে গুদাম ঘরে লুকিয়ে বসে রাতে হাতুড়ি পিটে অমনি বানানো যাবে। আর বড়ো মাস্টার ভূত দেখেছেন না হাতি দেখেছেন। ওসবে কান দিতে হয় না। ভজুদা চলে গেলে মনে হল কথাটা না তুললেই পারতাম। গুপি বারণ করেছিল।
সব শুনে, পরের রবিবার বড়ো মাস্টার বললেন, ভূত নেই বলেছে ভজু? চব্বিশ বছর বয়স হতেই সব জেনে ফেলেছে নাকি? আমার আটষট্টি বছর বয়স। যতই দিন যায় ততই বুঝি কিছুই জানা হয়নি, আসল জিনিসই সব বাকি আছে। শোন তবে। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের নাম শুনেছিস? এখনকার জয়ন্তিয়া কীরকম জানি না, কেঠো পা নিয়ে কোথায়ই-বা যেতে পারি বল? তবু মনে হয় মাঝে মাঝে দুটো পায়ের তলায় যেন জয়ন্তিয়া পাহাড়ের স্প্রিংয়ের মতো ঘাস এখনও টের পাই। মাইলের পর মাইল শুধু ঘাস আর বড়ো বড়ো পাথর। পাথরের যে দিকটাতে রোদ পড়ে না, সেদিকে নরম নরম শ্যাওলা হয়ে থাকে। তাতে শীতের আগে ছোট্ট ছোট্ট হলদে আর গোলাপি ফুল ফোটে, খুদে খুদে ফল ধরে। ঘাসজমির পাশেই হয়তো বাঁশ বন। সে-রকম বাঁশ বন তোরা দেখিসনি। গাঢ় কালচে সবুজ, আমার পায়ের তিনগুণ মোটা গুঁড়ি থেকে সরু হতে হতে ষাট ফুট উঁচুতে উঠে, কচি কলাপাতা রঙের একগুছি পাতা আর কড়ে আঙুলের মতো সরু একটা কুঁড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। গুঁড়ির পায়ে পুরু একটা খাপের মতো জড়ানো। তাতে মিহি রোঁয়া, ছুঁলেই আঙুলে লেগে যায় আর জ্বালা করতে থাকে। তার পাশে দিনরাত ঝর ঝর করে পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে জল পড়ে।
পাহাড়ের উপরে দেবদারুর বন। একবার আমার বন্ধু হরিদাস আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সবুজ পায়রা শিকার করার ইচ্ছা তার। ওখানকার লোকরা অনেক বারণ করেছিল, ও পাহাড়ে নাকি কেউ চড়ে না; পাহাড়ের দেউ ভারি রাগী; কেউ তাঁর জানোয়ার মারলে তাকে নাকি হাতে-নাতে সাজা দেন। জিনিস বইবার জন্যে পর্যন্ত একটা লোক পাওয়া গেল না। শেষটা নিজেরাই ব্যাগে করে খাবার, জলের বোতল, টোটা আর কাঁধে বন্দুক নিয়ে চললাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে একটা চড়াই পাখি পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। হরিদাসের কী রাগ। এ বনে জানোয়ার গিজগিজ করে, পাহাড়ের তলা থেকে ঝাকে ঝাকে সবুজ পায়রা উড়তে দেখা যায়, অথচ একটা কাঠবেড়ালি পর্যন্ত দেখা গেল না। বিরক্ত হয়ে আমাকে বলল, তুমি বড়ো খড়মড় করে হাঁট, তারিশব্দে জানোয়ার পালায়। শেষে ক্লান্ত হয়ে বনের মধ্যে ছোটো একটা ঝিলের ধারে বসে খাওয়া-দাওয়া করলাম। তারপর হরিদাস শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার কেমন বুকে ঢিপঢিপ করছিল, চোখে আর ঘুম আসছিল না।
এখানে বনের গাছগুলো যেন অন্য ধরনের, বড়ো বেশি ঘন, পাতাগুলো বড়ো বেশি বড়ো। হঠাৎ চমকে দেখলাম বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মিলিয়ে আছে অনেক হাতির পা; তাদের মস্ত কান নাড়াও দেখতে পেলাম। তাকিয়ে তাকিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিতে লাগল। জঙ্গলের ভেতরকার অন্ধকারে যেই চোখ সয়ে গেল, দেখি হাজার হাজার জানোয়ারের ভিড়, ছোটো বড়ো মাঝারি, বাঘ, ভালুক, হরিণ, ভাম, খরগোশ। গাছের ডালে ডালে পাখি। অথচ এতটুকু শব্দ নেই। হাতি দেখেই বন্দুক তুলে নিয়েছিলাম। এবার সেটা হাত থেকে খসে ঝিলের জলে পড়ে গেল। চারদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব। তারি মধ্যে হরিদাস উঠে বসে, পাগলের মতো এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে দেখে, বন্দুক সেইখানেই ফেলে রেখে উলটো দিকে টেনে দৌড়। ওই যে একটু শব্দ, একটু নড়াচড়া, অমনি দেখি চারদিক ভো ভা, কেউ কোথাও নেই। আমার শরীর কাপছিল, তবু এক-পা দু-পা করে বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম। গাছের নীচে পা দিতেই একটু হাওয়ায় ডালপালা দুলে উঠল আর আমার গায়ে মাথায় টুপটাপ করে সাদা সাদা বড়ো বড়ো ফুল। ঝরে পড়তে লাগল। অমনি আমার সব ভয় দূর হল। দেখলাম বনের মধ্যে একেবারে অন্ধকার নয়, গাছের ফঁক দিয়ে পড়ন্ত রোদ ঢুকছে। কী জানি মনে হল, দু-মুঠো ফুল কুড়িয়ে, বনের দেউকে মনে করে একটা গাছের গুঁড়িতে ছড়িয়ে দিলাম।