আমি বললাম, ভজুদাদের প্রিন্সিপালের নতুন গাড়ি হাওয়া।
বাবা চমকে উঠলেন! আরে, তোর মেজোকাকুর গাড়িও যে পোস্টাপিসের সামনে থেকে ঠিক সাত মিনিটের মধ্যে ডিস্যাপিয়ার্ড!
মা বললেন, কাল সন্ধ্যে বেলায় গেছে আর আজ দুপুরে চিড়িয়া মোড়ে পাওয়া গেল। সুখের বিষয়, পাঁচটা টায়ার, ব্যাটারি, যন্ত্রপাতির বাক্স আর হেডলাইট ছাড়া কিছু হারায়নি। থানার ওঁরা বলেছেন, পুরোনো হলে নাকি এইভাবে পাওয়া যায় আর নতুন হলে বেমালুম উধাও। আসবে ঠাকুরপো একটু বাদেই, তার কাছেই শুনো সব কথা।
বাবা কাষ্ঠ হেসে বললেন, স্রেফ বিদেশে পাচার। বিদেশ তো এখন বেশি দূর নয়। পদ্মাও পার হতে হয় না। তারপর ভজুদার কাছে শুনলাম যে এই গাড়ি চুরির ব্যাপারেও একটা ভালো দিক আছে। গড়ে নাকি এই কলকাতা শহর থেকেই রোজ একটা করে গাড়ি চুরি থানায় রিপোর্ট হয়। বেশ কয়েক হাজার বেকার লোক এই দিয়ে করে খাচ্ছে। সেটাকে খুব খারাপ বলতে পারলাম না। তবু একটু সাবধানে থাকাই ভালো। ভাগ্যিস দাদুর দেওয়া আমার এই দু-চাকার গাড়িটা তিনতলা থেকে নামে না। তবু আজ রাত থেকে ওটাকে আমার পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখব। এতটুকু টান পড়লেই চোর বাছাধন হাতে-নাতে ধরা পড়বেন। হতে পারে আমি চলতে পারি না, কিন্তু হাতে আমার খুব জোর। তা ছাড়া রাতে আমার ঘরে রামকানাই শোয়। সে রোজ ভোরে উঠে আদা দিয়ে ছোলা ভিজে খেয়ে, আধ ঘণ্টা বুকডন করে আর মুগুর ভাজে। খুব ঘামে।
গুপি বাড়ি যাবার জন্য উঠেছিল এমন সময় মেজোকাকু একজন মোটা বেঁটে লোককে নিয়ে উপস্থিত। লোকটাকে আগেও কাকুর বাড়িতে দেখেছি। ওঁর নাম নিতাই সামন্ত। ডাক নাম কানু। মেজোকাকু বলছেন নাকি উঁদে ডিটেকটিভ, ওঁর ভয়ে অনেক ঘাটে বাঘে গোরুতে একসঙ্গে জল খায়। গাড়ি চুরির কথায় বললেন, ওরা জানে না, কিন্তু ওদেরও এবার দিন হয়ে এসেছে। যে সে নয়, এবার বাছাধনরা বিনু তালুকদারের পাল্লায় পড়েছে। দিল্লির পুলিশের বিখ্যাত গোপন গোয়েন্দা বিনু তালুকদার। এদিকে অক্সফোর্ড থেকে বি.এ. পাস। নিজের চোখে না দেখলেও শুনেছি দেখে নাকি মনে হয় রোগা লিকলিকে নিরীহ মাস্টারমশাই, ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ওদিকে স্রেফ ম্যাজিশিয়ান!
গুপি বলল, ও মোটর চোরদের ধরে দেবে?
–দেবে না তো কী! তাদের ঘাঁটিসুদ্ধ বের করে দেবে। এবার আর ছাড়ান-ছোড়ন নয়। তালুকদার বলে গাড়িগুলো একবার গেল তো গেল! যতক্ষণ না চোররা ইচ্ছা করে পথের ধারে ফেলে রাখছে, ততক্ষণ তাদের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। তার মানে এইখানে এই কলকাতা শহরের মধ্যেই ওদের কোনো লুকোনো আস্তানা আছে। সেখানে চোরাই গাড়ির রং পালটানো হয়, নম্বর বদলানো হয়, চেহারা এমনি করে দেওয়া হয় যে তাদের আসল মালিকের নাকের সামনে দিয়ে চলে গেলেও মালিকরা টের পায় না। শুধু তাই নয়, যারা এই চোরাই ব্যাবসার পাণ্ডা তারাও ভোল বদলে এমনি ভালো মানুষ সেজে থাকে যে তাদেরও চেনা যায় না। এখানে ওখানে ভালো ভালো চাকরি-বাকরি করে, গাড়ি হাঁকায়। মাঝে মাঝে ওদের নিজেদের গাড়িও চুরি যাওয়া বিচিত্র নয়। একটা পান দিন তো।
এই বলে নিতাই সামন্ত খুব হাসতে লাগলেন। তারপর পান খেয়ে আরও বলতে লাগলেন।
এবার হয়েছে যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। বিনুর দলের টিকটিকিরাও শহরের চারিদিকে চারিয়ে আছে। তাদের টিকিটি চিনবার জো নেই কারো। চোরাচড় ধরবার জন্যে তারা চোরছ্যাঁচড় সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একেবারে ওদের দলের ভেতরে সেঁদিয়ে তারা সমস্ত ব্যাপারটাকে নস্যাৎ করে দেবে!
মেজোকাকু জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, এখানকার আশে-পাশেই কোথাও ওদের ঘাঁটি হয়তো। ওই তো গঙ্গার ঘাটে মালবোঝাই নৌকোর ভিড়। ওই কয়লা আর খড়ের তালের মধ্যে দিব্যি একটা করে আস্ত মোটর খুঁজে পাচার করে দেওয়া যায়। আরে, আমারই যে–এই অবধি বলে আমার আর গুপির দিকে তাকিয়ে মেজোকাকু চুপ করলেন।
নিতাই সামন্ত তাড়াতাড়ি বললেন, এইরকম জায়গাতেই আইনভঙ্গকারীরা থাকে! উঃ, তাদের মধ্যে দিব্যি আছেন, দাদা, জানলায় একটা শিক পর্যন্ত নেই!
বাবা একটু অপ্রস্তুত হলেন, ইয়ে তিনতলার উপর সে-রকম–
শুনে নিতাই সামন্তর সে কী কাষ্ঠ হাসি! ওই আনন্দেই থাকুন, স্যার! আপনার বাড়িটাকে চোরদের সোনার খনি বানিয়ে রাখুন! জানেন, ওরা টিকটিকির মতো দেয়াল বেয়ে ওঠানামা করে! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। আচ্ছা ওই সরকারি ছাপাখানার শেডে ওরা কারা গুলতানি করছে?
আমি বললাম, বড়ো মাস্টারের নাইট স্কুলের ছাত্ররা রবিবার ওখানে মিটিং করে।
নিতাই সামন্ত তো অবাক! তাইনাকি! বাঃ, বেড়ে আছে তো, দিনের বেলায় ছাপাখানায় ভালো মাইনের চাকরি, তেওয়ারির দোকানে চার বেলা পাতপাড়া, সন্ধ্যে বেলায় মিটিং আর রাতে– এই বলে নিতাই সামন্ত উঠে পড়লেন।
মেজোকাকুও উঠলেন, চলি রে পানু, নিতাইয়ের আবার নাইট ডিউটি আছে।
ওঁরা দরজার কাছে যেতেই বাবা গুপিকে বললেন, কী রে, তোর বাড়িঘর নেই নাকি? যা, ওদের সঙ্গেই যা। তারপর দমাস দমাস করে আমার জানলা দুটো বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন। হাসি পেল। যে-কেউ ইচ্ছা করলেই পাশের বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে রাস্তা থেকে উঠে এসে, একটা তক্তা ফেলে আমাদের ঘোরানো সিঁড়িতে উঠতে পারে। রাতে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ থাকে বটে, কিন্তু কার্নিশ দিয়ে দু-হাত হাঁটলেই আমাদের পিছনের বারান্দায় ওঠা যায়। তারপর দরজার খড়খড়ির ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে খাবার ঘরের দরজা খুলে ফেলা যায়। রামকানাই নিজে একবার দেরি করে ফেলে, বাইরে বন্ধ হয়ে গিয়ে ওইরকম করে এসেছিল।