মাঝিদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তারাও কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। নোঙর তুলে, ডাঙায় ফেরার দিকে তাদের মন। নাকি ঝড় উঠছে। দেখতে দেখতে হাওয়া পড়ে গেল, পশ্চিম দিকে মেঘ জমা হতে লাগল। তার পরেই সূর্যটা একেবারে মুছে গেল। দোতলার সমান উঁচু কালো ঢেউ আমাদের উপর লাফিয়ে পড়তে লাগল। ছোট্ট একটা খেলনার মতো আমাদের নৌকোও একবার ঢেউয়ের মাথায় ওঠে, তার পরেই ঝপাস করে পড়ে। মাঝিরা ওস্তাদ, তারা ঠিক হয়ে রইল। পরে জানতে পেরেছিলাম যে ঢেউয়ের ঝাপটা খেতে খেতে শেষপর্যন্ত তারা পরদিন ভোরে আধমরা অবস্থায় নিরাপদ ডাঙায় পৌঁছোতে পেরেছিল। কিন্তু ঝড়ের গোড়ার দিকেই একটা মস্ত ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিল।
খানিকটা হাঁসফাঁস করলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান হল দেখি মহাসাগরের মাঝখানে একটা অজ্ঞাত দ্বীপের বালির তীরে পড়ে আছি। সে কী দ্বীপ! সত্যি বলছি তোদের, পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে সে সেইখানে। মানুষের বাস নেই; বনমানুষেরা উঁচু গাছে রাত কাটায়। শিম্পাঞ্জিকে বনমানুষ বলে তা জানিস তো? আর গাছে গাছে যত ফুল তত ফল। কত যে পাখি তার ঠিকানা নেই। উড়ে এসে কাঁধে বসে, হাত থেকে ফল খায়। ঘাসের উপর খরগোশরা লাফিয়ে বেড়ায়, আমাকে দেখে এতটুকুও ভয় পায় না। দলে দলে হরিণ চরে বেড়ায়। গাছের কোটরে এত বড়ো বড়ো মৌচাক।
সারাদিন গাছের পাতার মধ্যে সমুদ্রের হাওয়ার শব্দ, পাখির গান, ঝরনার জল পড়ার আওয়াজ। চোখের সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ওড়ে; তার পিছনে হলদে বালির তীরে সমুদ্রের সবুজ ঢেউ সারাক্ষণ আছড়ে পড়ে।
মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখের সামনে থেকে অন্ধকারে-ভরা নিজের ঘরটা কোথায় মুছে গেল, ফুটপাথের চায়ের দোকানের ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ আমার নাক অবধি পৌঁছোল না, গা শিরশির করতে লাগল। গুপি ব্যস্ত হয়ে বলল, তারপর সেখান থেকে ফিরে এলেন কী করে? কেন এলেন? ই-স্, সেখানে নিশ্চয় গাছে চড়লেই পাখির ডিম! আর হরিণ মারা আর খাওয়া। আচ্ছা, মাস্টারমশাই খরগোশের মাংসও–।
মাস্টারমশাই হঠাৎ কর্কশ গলায় বললেন, চুপ!– ঢিল ছুঁড়ে একটা সবুজ পায়রাকে জখম করেছিলাম। মাটিতে পড়ে সেটা ছটফট করছিল; চোখের কোনা দিয়ে একটু রক্ত গড়াচ্ছিল। অমনি শিম্পাঞ্জির দল আমার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, একটা নারকোল গাছের গুঁড়ি পড়েছিল, তাতে আমাকে চাপিয়ে, ঠেলে ঠেলে ঢেউ পার করে দিয়ে এল। ভাটার টানে কোথায় যে ভেসে গেলাম তার ঠিক নেই। ভাগ্যিস একটা জাপানি সদাগরি জাহাজের চোখে পড়ে গেলাম, নইলে সেযাত্রা হয়েছিল আর কী! মাস্টারমশাই হঠাৎ কাঠের পা ঠুকে উঠে পড়লেন।
গুপি বলল, এক্ষুনি চলে যাবেন না, মাস্টারমশাই, কী করে বর্মা ছেড়ে চলে এলেন, বউঠানের কী করে মুখ পুড়ল, সেসব কথা–
মাস্টারমশাই বেজায় রেগে গেলেন। আমাকে বললেন, তোরা বড়ো বেশি কথা বলিস। অন্য লোকের দুঃখ কষ্ট নিয়ে খুব মজা পাস, না?
আমি বললাম, না মাস্টারমশাই, না। আমাদেরও দুঃখ হয়, মজা পাই না।
মাস্টারমশাই বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, থাক এখন। আরেক দিন বলব। উঠি। আমার নাইট স্কুলের ছেলেরা এক্ষুনি আসবে। মিটিং আছে। তলাপাত্র রইল, ওর সঙ্গে গল্প কর।
মাস্টারমশাই চলে গেলেই ছোটো মাস্টার মোড়া থেকে উঠে সেই চেয়ারে বসে বললেন, আমার কাছে মহাকাশযাত্রা সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো ইংরিজি বই আছে।
গুপি হঠাৎ মুখের উপর আঙুল রেখে বলল, চুপ করে শুনুন! ওইযে ঠক্ঠক্ঠক্ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না? স্পেসশিপ বানাচ্ছে।
ছোটো মাস্টার চমকে গিয়ে আর একটু হলে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম, আঃ গুপি! সবাইকে সব কথা বলা কেন?
কিন্তু ছোটো মাস্টারও কিছুতেই ছাড়বেন না, কী স্পেসশিপ, কে বানাচ্ছে বলতেই হবে! আমাকে না বলার কারণ নেই। আমি তো আর কাউকে বলতে যাচ্ছি না!
তখন আমি বললাম, সরকারি ছাপাখানার ওপাশে চার বছর ধরে ওই যে মস্ত বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, গুপি বলে ওখানে মহাকাশযান তৈরি হচ্ছে।
ছোটোমাস্টার তো অবাক। সে কী? শুনলাম ওটা ঠান্ডাঘর। ওখানে আলু পেঁয়াজ জমা থাকবে। ও-পাশেই গঙ্গা। লম্বা চোঙাপথ দিয়ে একেবারে জাহাজের খোলে মাল বোঝাই হয়ে বিদেশে যাবে। বড়ো মাস্টার তো তাই বললেন।
গুপি কাষ্ঠ হেসে বলল, ঠান্ডাঘর করতে কখনো চার বছর লাগে?
০৩.
ঠিক এই সময় কলেজের বিকেলের ক্লাস সেরে ভজুদা এসে উপস্থিত হলেন। মুখে শুধু এক কথা। ওঁদের কলেজের প্রিন্সিপালের নতুন গাড়ি দিনদুপুরে, কলেজের গেটের ভিতর থেকে, একরকম দরোয়ানের নাকের ডগার তলা দিয়ে চুরি গেছে। এই অবধি শুনে ছোটো মাস্টার সুড়সুড় করে সরে পড়লেন। -বাবাও তখনি বাড়ি এলেন। সিঁড়িতে ছোটো মাস্টারের সঙ্গে দেখা।
ঢুকেই বাবা আমাকে বললেন, কে ওই স্লিপারি কাস্টমারটি? সোজা তাকায় না কেন?
মা-ও বললেন, যাকে তাকে ঘরে ঢোকাস নি বাবা, কতবার বলেছি।
আমি রেগে গেলাম, কিন্তু কিছু বলার আগেই গুপি আস্তে আস্তে বলল, না মাসিমা, উনি ভালো লোক, বড়ো মাস্টারমশাইয়ের নতুন অ্যাসিস্টেন্ট। ওঁর নাম তলাপত্র, এম. এ. পাস।
বাবা বসে পড়ে বললেন, কোত্থেকে ধরে আনে এসব লোক? যেভাবে মাথা নীচু করে পাশ কাটিয়ে হন হন করে নেমে গেল, আমি ভাবলাম নির্ঘাত কিছু সরিয়েছে। কেমন আছ, ভজু?