সমস্ত বইটা গুপি এরমধ্যে একবার পড়ে ফেলেছে। অদ্ভুত জীবনযাত্রা ওখানকার। নাকি মহাকাশ-ট্রাকে করে মাটি নিয়ে গিয়ে তবে ধান-গম ফলাতে হবে। তাও সম্ভবত মাটির নীচে খেত বানিয়ে। সূর্যর এমনি তেজ যে দিনের তাপমাত্রা + ২০০ ডিগ্রি আর রাতের–২০০ ডিগ্রি! সব ঝলসিয়ে জমিয়ে শেষ করে দেবে। যদি-না মাটির তলায় ফসল ফলানো হয়। এক ফোঁটা জল নেই, দু-ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন মিলিয়ে জল তৈরি করতে হবে। সে একেবারে বোতলে-পোরা বিশুদ্ধ জল, খেলে কারো অসুখ করবে না। অক্সিজেনও ওখানে পাওয়া যাবে না, সম্ভবত হাইড্রোজেনও না। সব পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে। বাঁচতে হলে সবাইকে বোতল-ভরা অক্সিজেন শুকতে হবে। গুপির ছোটো মামা তার মস্ত ব্যাবসা করে, দেখতে দেখতে ফেঁপে উঠবেন। আগেই বলেছি যারা প্রথম চাঁদে জমি কিনবে, গুপির ছোটো মামা তাদের মধ্যে একজন। এই ব্যাপারে তিনি আমেরিকায় এরই মধ্যে একটা দরখাস্ত পর্যন্ত দিয়ে রেখেছেন। প্যান্-আম্ নাকি টিকিট বিক্রি করবে।
অবিশ্যি ওঁদের বাড়িতে এ-বিষয়ে কেউ এখনও কিছু জানে না। কারণ গত বছর সামান্য কয়েকটা নম্বরের জন্যে বি.এসসি. পাস করতে না পারায়, বাড়িতে তাকে উদয়াস্ত যা নয় তাই শুনতে হয়। তাতে অবিশ্যি তার চাঁদের ব্যাবসা কিছু উঠে যাচ্ছে না, ছোটো মামা গুপিকে বলেছেন, পরে এরাই কত খোশামোদ করবে।
গুপি বইটাতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, আমরাও ওই ব্যাবসায় ঢুকে পড়ব। ছোটো মামার চাঁদের বাড়িতে থাকব, মেশিনের সাহায্যে ওর কাজ-টাজ করে দেব। তুই তো খুব ভালো মাংস রেঁধেছিলি সেবার যখন ডায়মন্ড হারবারে পিকনিক হয়েছিল। আর দ্যাখ, নেপাকেও নিয়ে যাওয়া যাক। দেখিস কেমন দেখতে দেখতে এই বিরাট বাঘের মতো হয়ে যাবে। ওখানে বাতাসের প্রেসার নেই বলে সবাইকে প্রেসার সুট পরতে হবে। নেপোকে পরাব না। বাতাসের চাপ না থাকায় ব্যাটা এই এত উঁচু হয়ে উঠবে, বেশ আমাদের বাড়ি পাহারা দেবে। ওদিকে প্যান্টের মধ্যে পুরে লুকিয়ে নিয়ে যেতে পারব, কেউ টেরও পাবে না। নইলে বেড়ালদেরও চাঁদে যেতে মোটা টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হবে।
বড়ো মাস্টার সঙ্গে করে তার নতুন ছোটো মাস্টারকে নিয়ে এসেছিলেন। রোগা, ফর্সা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পাতলা চুল, নাকি সবে টাইফয়েড থেকে উঠেছেন। দু-জনে হাঁ করে গুপির কথা শুনছিলেন আর একটার পর একটা অনেকগুলো মাংসের শিঙাড়া খাচ্ছিলেন। ভজুদা তখনও আসেননি।
গুপি বলে চলল, ওখানে খুব রোবো ব্যবহার হবে। তারাই চাষ করবে, কারখানায় কাজ করবে। নইলে অত অক্সিজেন কে জোগাবে? তা ছাড়া রোবোদের খিদেও হয় না, অসুখও হয় না, ভারি সুবিধা। নইলে চাদে গোরু-মোষ নিয়ে গেলে, সেগুলো তো দেখতে দেখতে আট নয় ফুট উঁচু হয়ে উঠবে। তাদের খাবার জোগাতেই ট্যাক গড়ের মাঠ হবে। মাটির তলায় বাঁধা থাকবে, গোয়ালে অক্সিজেন ভরা থাকবে। রোবোরা তাদের দুইলে মন মন দুধ পাওয়া যাবে। কে জানে ছোটোমামাও হয়তো একটা গোরু কিনে ফেলতে পারে। পায়েস আর রসগোল্লা করাটা ইতিমধ্যে শিখে নিস, পানু।
বড়ো মাস্টার একটু চা খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে এতক্ষণে কথা বললেন, অত অক্সিজেন কোথায় পাবে?
গুপি খুব হাসতে লাগল, ছোটোমামা বলেছে যেসব কারবন ডাই-অক্সাইড আমরা নিশ্বাস ফেলব, সেগুলোকে আবার অক্সিজেন বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছে শিগগির। একরকম গাছের সাহায্যে।
নতুন মাস্টার এবার বললেন, কিন্তু বন্ধ বালতিতে দুধ দুইতে হবে, নইলে ছলকিয়ে সব বেরিয়ে আসবে। হাওয়ায় চাপ নেই তো!
বড়ো মাস্টার মাথা নাড়তে লাগলেন। উনিও গুপির ঠাকুরদার সঙ্গে একমত। এই পৃথিবীটারই সব কিছু দেখার সময় হয় না, তা আবার চাদে যাওয়া। গুপি বিরক্ত হয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আমি বললাম, চাদে যাওয়াটাই আসল কথা নয়, মাস্টারমশাই। চাঁদটা হবে একটা ছোটো স্টেশন। সেখানে মহাকাশের আপিস থাকবে; ওইখানে অন্যান্য গ্রহে যাবার টিকিট কাটা যাবে। কারখানা থাকবে, মহাকাশযান মেরামত হবে। চাদে আমরা চিরকাল থাকব না।
মাস্টারমশাই হঠাৎ গুপির দিকে তাকিয়ে বললেন, বর্মা গিয়েছ কখনো? গুপি মাথা নাড়ল। মাস্টার বললেন, আমি বর্মায় থাকতাম। সালওয়েন নদীর ধারে সেগুন কাঠের মস্ত ব্যাবসা ছিল। আমার বাবা অনেক টাকা করেছিলেন। আমাদের নিজেদের এরোপ্লেন ছিল, নৌকো ছিল, মাঝসমুদ্রে যাবার বড়ো বড়ো মোটরবোট ছিল। সমুদ্রের ঝড় দেখেছ কখনো?
গুপি একটা চেয়ারে বসে পড়ে, সেটাকে টেনে মাস্টারের খুব কাছে নিয়ে গেল। ততক্ষণে আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, বাড়ির সবাই দাদুর বাড়ি চলে গেছে। ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসছে, তবুআমার ঘরে আলো জ্বালা হয়নি, ভজুদাও আসেননি, মাস্টার বললেন, একবার দারুণ ঝড়ে পড়েছিলাম। তখন আমার কুড়ি বছর বয়স। রেঙ্গুনের কলেজ থেকে সবে বি.এ. পাস করে বেরিয়েছি। মাঝিদের সঙ্গে মাঝসমুদ্রে মাছ ধরতে গেছিলাম। ওখানে ওরা প্রকাণ্ড সব মাছ ধরে, এক মন, দেড় মন, পর্যন্ত। সমুদ্রের জলটা এত পরিষ্কার যে অনেক নীচে অবধি দেখা যায়। কোথাও কোথাও তলা অবধি দেখতে পাচ্ছিলাম। হয়তো সমুদ্রের নীচে সেখানে চড়া পড়েছিল। সূর্যের আলো সেখানে ফিকে সবুজ হয়ে পৌঁছোচ্ছিল। দেখলাম বড়ো বড়ো সমুদ্রের আগাছা, জলের নীচে বালির উপর একটু একটু দুলছে। মাঝে মাঝে ঝাকে ঝাকে ছোটো রঙিন মাছের দল ভেসে যাচ্ছে। থেকে থেকে বড়ো বড়ো কালো ছায়ার মতো কী যেন এগিয়ে আসছে। তাই দেখে মাঝিরা কথা বন্ধ করে একেবারে চুপ; নোঙর-ফেলা নৌকোটাও স্থির, শুধু ঢেউয়ের দোলায় একটু একটু দুলছে। একবার মনে হল জলের নীচে মস্ত একটা চোখ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বুক্টা টিপ ঢিপ করে উঠল। গাটাও কেমন শিরশির করতে লাগল। তখনও আমার দুটো ঠ্যাং ছিল না। এখন আর কেয়ার করি না।