সিঁড়ি বেয়ে ঠান্ডাঘরের ছাদে গিয়ে দেখেন, সামনে নাইলনের মই ঝুলছে। তাই বেয়ে একেবারে বড়ো মাস্টারের ঘরে, পোড়া বউয়ের মুখোমুখি। কিন্তু সে পোড়া বউ নয়। একহাত ঘোমটা, ঝোলা গোপ, মোটা বেঁটে গোরিলা ঘোষাল হার্মোনিয়ম পালিশ করছে। ওকে দেখে সে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল। তারপর এক মিনিটের মধ্যে বগলদাবা করে, স্বচ্ছন্দে দড়ির মই বেয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে একেবারে ঠান্ডাঘরে। তারপর বেড়ালের খাঁচার অন্য অর্ধেকে পুরে বাইরে থেকে শিকল তুলে, কাষ্ঠ হেসে, কোনো কথা না বলে, আবার সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য। সেই ইস্তক ছোটোমামা ওইখানে বন্ধ, চাঁচাবারও জো নেই। শব্দ করলেই বেড়ালেরা নাকি নখ বার করে। তারপর সামন্ত সাত-আট জন পুলিশ নিয়ে ঢুকলেন। এসেই আগে খাঁচার দরজা খুলে দিলেন।
নিতাই সামন্ত খুব হাসতে লাগলেন। আর বলেন কেন, দাদা, খাঁচা খুললেও বেরোয় না। টেনে বের করতে হল। তখন আবার কিছুতেই নড়ে না, দ্বিতীয় খাঁচার বেঁড়ে ল্যাজের বেড়ালটাই নাকি নেপো। ওকে না নিয়ে নড়বে না। অগত্যা তাদের সবাইকে ছাড়া হল। তারা আবার আমাদের পা ঘেঁষে সঙ্গেসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। তারপর সে যা হই হই! গোরিলা ঘোষাল লাঠি হাতে তেড়ে এল। গুপি আর চাঁদুতখুনি দুদ্দাড় দৌড়। পিছন পিছন গোরিলা ছুটল। পানুই শেষটা ওদের বাঁচাল এ আমি বলতে বাধ্য।
একটু খুশি না হয়ে পারলাম না। নিতাই সামন্ত বললেন, অনেক কষ্টে গোরিলাকে ধরা হল। তারপর তাকে আমাদের ভ্যানে তুলে বড়ো মাস্টারের খোঁজে ছাপাখানায় গিয়ে দেখি তিনি চোখে ম্যাগনিফাইং চশমা এঁটে প্রুফ দেখছেন। এতসব কাণ্ড হল, তার কিছুই নাকি টের পাননি! বুঝলেন দাদা, ওই নাইট স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে বিনু তালুকদারের চর ছিল। দোকানের বুড়ি সেজে ঘুঘু সমাদ্দার খবর সংগ্রহ করে দিত। বিনু তালুকদার একবার ধরলে কাউকে ছাড়ে না। এসব প্ল্যান তারই।
এই অবধি বলে নিতাই সামন্ত হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।
এর মধ্যে বিনু তালুকদার কোত্থেকে এল বুঝলাম না।
বাবা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
মি. তালুকদার তো কই এখনও এলেন না?
আসবেন, আসবেন। ওই বড়ো মাস্টারটিকে নিয়েই হয়েছে মুশকিল। সব দেখে-শুনে মনে হয় দাদার সঙ্গে হ্যাঁন্ড-ইন-গ্লভ যাকে বলে। অথচ বেআইনি কিছু করছেন বলে প্রমাণ খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে কী বলছেন জানেন, ওঁর দাদার নাকি একা জেলে কষ্ট হবে, ওঁকে সাকরেদ বলে ধরতে হবে। তা হলে নাকি বর্মার জঙ্গলে নাম দিয়ে অদ্ভুত স্মৃতিকথা লেখার সময় পাবেন।
মেজোকাকুও হেসে কুটোপাটি। শোন একবার কথা! লোকটা চব্বিশ পরগনার বাইরে কখনো পা দিল না, উনি আবার বর্মার জঙ্গলে লিখবেন।
ভীষণ রাগ হল! আমি কিছু বলার আগেই গুপি চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলতে লাগল, কিছু দরকার নেই বর্মা যাবার। লিখতে হলে যাবার দরকার করে না, লিখবার ক্ষমতা থাকলেই হল।
ঠিক এই সময় সুড়সুড় করে ছোটো মাস্টার ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে দেখেই গুপি রেগে চতুর্ভুজ হয়ে উঠল। কাল আমাকে শত্তরের গর্তে ঠেলে দিয়ে কোথায় কেটে পড়লেন, স্যার? আমি
কানু সামন্ত ছুটে এসে গুপির মুখ চেপে ধরে বলল, স্স্স্ কাকে কী বলছ! উনিই বিনু তালুকদার, ছোটো মাস্টারের ভেক ধরে এমনকী আমার পর্যন্ত চোখে ধুলো দিয়েছিলেন।
গুপি আমার দিকে তাকাল। আমি গুপির দিকে তাকালাম। তারপর গুপি ছুটে গিয়ে ছোটো মাস্টারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, স্যার, আমিও পুলিশে চাকরি করব।
বিনু তালুকদার ওর পিঠ চাপড়ে, আমার দিকে চেয়ে বললেন, স্পেসশিপের মডেলটা
আমি বললাম, বি.এসসি. পাস করে আমিও পুলিশে ঢুকব। চাঁদে গিয়ে কাজ নেই। যাওয়া হবেও না।
–হবে না মানে? এই হল বলে! তারপর স্পেসশিপেও গুপ্ত গোয়েন্দা রাখা হবে। ওঃ, বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, তোমাদের বড়ো স্যার রবিবারে এসে তোমাদের গল্প বলবেন। বর্মার সব ভালো ভালো অভিজ্ঞতা মনে পড়েছে, এক দিন ফাটকে বসে বসে। এখন স্নান-খাওয়া করতে বাড়ি গেছেন।
তখন গুপি আর আমি উঠে গিয়ে খাবার ঘরের দিকে চললাম। সঙ্গেসঙ্গে নেপোও চলল। বেঁড়ে ল্যাজ খাড়া করে।