কখন যেন বাবা এসে দাঁড়িয়েছিলেন টের পাইনি। বেজায় আশ্চর্য হয়ে বললেন, বেড়ালের হার্মোনিয়ম আবার কী?
আমি বললাম, সেই যে সুবিমল রায় সন্দেশে লিখেছিলেন, কে যেন বানিয়েছিল। কাঠের খোপে খোপে বেড়াল বসাতে হয়, তলা দিয়ে ল্যাজ ঝোলে। একেক বেড়ালের একেক সুর হওয়া চাই, সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা। ল্যাজ ধরে টানলেই বেড়াল ওই সুরে ম্যাও ধরে। দিব্যি গানটান বাজানো যায়।
বাবা বললেন, পাগল নাকি?
গুপি একটু চটে গেল। না কাকা, পাগল নয়। অনেক বেড়াল জোগাড় করতে হত, তাদের সুর ঠিক চিনে গলায় টিকিট ঝোলানো হত। টিকিট তো সবাই দেখেছে। নেপোর গলাতেও ছিল।
বড়ো মাস্টার ওর ল্যাজে পা দিতেই ও একেবারে এক টানে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি সা আ-আ করে চেঁচিয়ে উঠে দেপিট্টান। বড়ো মাস্টার বাড়ি গিয়ে দাদার কাছে ওই কথা বললেন! শুনে অবধি দাদা আর বড়ো মাস্টারকে ছাড়ান দেয়নি। ওটি আমার চাই, ডি লুক্স হার্মোনিয়ম বানাব। বড়ো মাস্টার দাদাকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে বেড়াল জোগাড় করে দিতেন। নইলে দাদা কোথায় কী করে বসবে তার ঠিক কি। নাকি সতেরো বার জেল খেটেছে, পৃথিবীর নানান দেশে, নানান নামে। ওই ছাদে বেড়ালরা চরত। মাছ আসত ওদেরই জন্যে। কিন্তু বেশি খেলে গলার সুর খোলে না। তাই খাওয়া কমানো হয়েছিল। ঠান্ডাঘরের চোরাই গাড়ির কারখানায় ওরা থাকত। খাওয়া কমানোতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অমনোনীতরা ছাড়াই থাকত। তেওয়ারি তাদের গলা সাধাত। মহা দৌড়ঝাঁপ করত ওরা। সেদিন ছোটোমামা চোঙা খুলতেই ওরাইনদীর স্রোতের মতো বেরিয়ে এসেছিল। চোঙার বাইরে থেকে মাছের গন্ধ একটুখানি নাকে ঢুকতে-না-ঢুকতেই।
আমি বললাম, আর ছোটোমামা?
গুপি একটু হাসল। ছোটোমামাই তো চোঙা দিয়ে কারখানায় ঢুকে, বেড়ালদের খাঁচা আবিষ্কার করে, নিজেই একেবারে থ। ছোটোমামা একটা হিরো।
এই বলে গুপি আরও খানিকটা কেঁদে নিল।
আমি বললাম, ওরকম করিস না। তাহলে আরেকটা দামোদর ভ্যালি তৈরি হয়ে যাবে।
গুপি বলল, চাঁদে যাবে না বলছে যে। নাকি বড্ড হাঙ্গামা।
বেজায় রাগ হল। চেঁচিয়ে বললাম, চাদে যাবে না তো করবেটা কী শুনি?
গুপি বলল, পুলিশে চাকরি নেবে। ওই হল তিন নম্বরের শক!
–পু-পুলিশে চাকরি নেবে? সে আবার কী?
–বিনু তালুকদার ওকে হাত করেছে বুঝলি-না। ওকে দিয়ে কাজ হাসিল করেছে, এখন আর কি ওকে ছাড়ে।
বাইরের দরজার ঘন্টি পড়ল। বাবা লাফিয়ে উঠে বললেন, ওই যে মি. তালুকদারের দল এলেন বোধ হয়।
সঙ্গেসঙ্গে মেজোকাকু আর নিতাই সামন্ত ঘরে ঢুকে ধপাধপ করে একেকটা চেয়ারে বসে, কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। মেজোকাকু বলেলন, উঃ, সাধে লোকে ওর নাম দিয়েছিল গোরিলা ঘোষাল! গায়ে কী জোরটা দেখলে? একবার গা ঝাড়া দেয় তো তোমাদের সব চাইতে জোরালো পাঁচ-ছয়টা ছিটকে পড়ে! আবার তেজ কত! বুক চাপড়ে বলল, কী করবি রে তোরা আমার? বউ সেজে ঘোমটা দিয়ে সাত বছর কাটালাম, এখন আর আমার ভয়ডর বলে কিছু নেই। দে না পাঁচ বচরের জন্যে জেলে। পায়ের উপর পা দিয়ে তোদের পয়সায় দু-বেলা খাব আর আমার হার্মোনিয়মের বইটা এই অবসরে লিখে ফেলব!–চাদু এল না; কালকের অত উত্তেজনার ফলে ওর পেটের অসুখ করেছে। গুপিদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। বাড়ি গেলে বুড়ো ওকে মাটিতে বিছিয়ে দেবে।
নিতাই সামন্ত বললেন, কী জানি শেষপর্যন্ত গাড়ি চুরির কেসটা টিকবে কিনা। ওখানে তো ওই দুটো ভাঙা গাড়ি ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। নাকি গাড়ি সারাবার কারখানা। ও দুটোকে সের দরে কিনেছে। লাইসেন্স নেই বলে লুকিয়ে কাজ করে। এদিকে বেড়ালের হার্মোনিয়ম তৈরি করা কিছু বেআইনি নয়। ওই লাইসেন্স নেই বলেই যা খানিকটা জরিমানা করা যেতে পারে।
বাবা বললেন, সবটা খুলে না বললে ঠিক বুঝতে পারছি না।
সামন্ত বললেন, তাও বুঝলেন না? এর মধ্যে দুটো ব্যাপার জড়িত, এক গাড়ি চুরি, দুই বেড়াল চুরি। চোরের সর্দার কিন্তু একজনই। ওই যে বললাম গোরিলা ঘোষাল, বড়ো মাস্টারের দাদা। ঠান্ডাঘরটা একটা ভাঁওতা। ওটা আসলে মোটরের কারখানা। আমাদের বিশ্বাস চোরাই গাড়ির, কিন্তু তার কোনো প্রমাণ পাচ্ছিনা। তা ছাড়া হামোনিয়মের কাঠের খোল তৈরি হয় ওখানে। তারইঠক ঠক শোনা যায়। এঁয়ারা তাই শুনে ওই স্পেসশিপ বানাচ্ছে, বলে আহ্লাদে আটখানা!
দেখলাম চমৎকার ব্যবস্থা। ঠান্ডাঘরের ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে ভিতরে। ছাদের কোনা দিয়ে নাইলনের দড়িরমই বেয়ে ঘুলঘুলির ভিতর দিয়ে বড়ো মাস্টারের ঘরে যাওয়া যায়। আবার সেখান থেকে বড়ো সিঁড়ি দিয়ে ছাপাখানার ভিতরে নামা যায়। নাইট ওয়াচম্যানের ঘরেও ঢোকা যায়। তাড়া খেয়ে গুপিরা তাই করেছিল। তারপর পানু তক্তা ফেলে দিতেই এ-বাড়িতে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। নইলে গোরিলা ওদের মেরে পাট করে দিত! তার আগে কী হয়েছিল সেকথা গুপিই ভালো বলতে পারবে। আমি তো তখনও পৌঁছোইনি।
গুপি দেখলাম খুব খুশি। হাসতে হাসতে বলল, ছোটো স্যারের সঙ্গে গলি দিয়ে ঢুকে ও মাথায় গিয়ে দেখি ঠান্ডাঘরের গায়ের ছোটো দরজাটা খোলা, হাওয়ায় দুলছে। ওইখানে গিয়ে ঢুকলাম। একটা প্যাসেজ দিয়ে যেতেই কারখানা। লোহালক্কড়, কাঠের উঁই, যন্ত্রপাতি। তেলে প্যাঁচপেচে বিশ্রী জায়গা। একটা নিয়নবাতি জ্বলছে। কেউ কোথাও নেই। তারপর একটা ফাঁস ফাস ফোঁস ফোঁস ম্যাও ম্যাও মিউ মিউ শুনে দেখি বিরাট এক খাঁচার খোপে খোপে শত শত বেড়াল। এমন সময় কাতরকণ্ঠে কে বলল, বাঁচাও! এ ছোটোমামা না হয়ে যায় না। দেখি মস্ত খাঁচার এক ধারে আলাদা খোপে গুঁড়ি মেরে ছোটোমামা বসে। ভয়ে আধমরা। চোঙা দিয়ে ওকে নামতে দেখেই কারখানায় যারা কাজ করছিল তারা নাকি ভূত ভূত বলে খিড়কি দোর খুলে দে দৌড়। ছোটোমামা ঘরটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন ছাদ অবধি সিঁড়ি উঠে গেছে।