নিতাই সামন্ত বললেন, তাই নাকি? ভাগ্যিস গুপিরা গেছিল।
ছোটোমামা চিঁচিঁ করে বললেন, মোটেই ওরা আমাকে উদ্ধার করেনি। আমিই বরং—
গুপি বলল, ফের।
ছোটোমামা থেমে গিয়ে ঢোক গিলতে লাগলেন।
বাবা আর মেজোকাকু একসঙ্গে বললেন, এবার তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন হোক।
নিতাই সামন্ত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ধৈর্য ধরুন। বিনু তালুকদার হয়তো রিং লিডারদের নিয়ে এখানে আসবেন, মোকাবিলা করতে। অর্থাৎ সবাইকে মুখোমুখি এনে ব্যাপার খোলসা করতে। তেওয়ারি রাখুর দলও আসবে, কিছু আসবাব সরালে ভালো হয়।
আমি বললাম, আমার ঘরে কেন? তার চেয়ে সবাই মিলে বসবার ঘরে গেলে হয় না?
সামন্ত বললেন, আরও ভালো হয় একদল যদি এখনই খেয়ে নেয়। চাঁদু, গুপি, পানু, এরা খেয়ে নিক। দেখো, আবার পালাবার চেষ্টা করলে হুলিয়া লাগিয়ে ধরিয়ে এনে ফাটকে দেব কিন্তু। আর ভালোমানুষের মতো খেয়ে নিলে, তোমাদের স্টেটমেন্ট নিয়ে, আমার জিপে করে যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দেব! তোমরা কিছু আসামি নও, তোমরা হলে পুলিশের পক্ষের সাক্ষী।
দরজার কাছ থেকে রামকানাই বলল, কোনো ভয় নেই। খাবার ফেলে ওনারা সগগেও যাবেন। রান্না তৈরি।
বাবা বললেন, চোপ।
ছোটোমামা বললেন, খেয়ে এসে সব বলব। কিন্তু আমাকেও গুপিদের ওখানে পাঠাবেন। বাবার কাছে এমনি গেলে, বাবা দাড়ি ছিঁড়ে দেবেন।
খেয়ে-দেয়ে সবে এসেছি অমনি আমাদের সদর দরজার ঘন্টি তিন বার বেজে উঠল। নিতাই সামন্ত লাফিয়ে উঠলেন, ওই ওই বিনু তালুকদারের লোকের সংকেত। আপনারা তিনটে বড়ো বড়ো শকের জন্য প্রস্তুত হোন।
আমার পকেট থেকে বিদ্যুৎ আবার বকম-বকম করতে লাগল। আর নেপো তার পিঠটাকে কুলোর মতো করে, লোম ফুলিয়ে তিনগুণ বড়ো হয়ে, দাঁতের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত একটা ট স্ স্ স্ স্ শব্দ করতে লাগল।
১১.
শেষপর্যন্ত সে-রাত্রে আর কিছু শোনা হল না। ডাক্তারবাবু নিশ্চয় আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলেন। হঠাৎ কেমন ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে গুপি আমাকে ঠেলে তুলল। রাতে সে বাড়ি যায়নি। আমার ঘরের কৌচে ঘুমিয়েছিল। অথচ আমি সে-বিষয় কিছুই জানি না। ছোটোমামার দেখা নেই।
চোখ খুলতেই গুপি আমার হাতে আমার হারানো খাতা গুঁজে দিল। দুমড়োনো মুচড়োনো আঁচড়ানো কামড়ানো। এই আমার সেই আদি নেপোর বই। পরে গুপি নিয়ে গিয়ে মোড়ের মাথায় দোকান তেকে বাঁধিয়ে দিয়েছে। এতে আমি সমস্ত ব্যাপারটার যতখানি মনে আছে লিখে রেখেছি। যেমন মলাটে নেপোর বই নাম লেখা ছিল, তেমনি আছে। ভেবেছিলাম কেমন বাড়েটাড়ে বাচ্চা বয়স থেকে সব লিখে রাখব। সে আর নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া সব কথা লেখাও যায় না। মহা পাজি।
খাতা পেয়ে অবাক হয়ে উঠেবসে গুপির দিকে তাকালাম। গুপি বলল, কাল বড়ো মাস্টারের ঘর থেকে ছোটোমামা ওটাকে উদ্ধার করেছিল।
এমনি অবাক হলাম যে পায়ের জোর চলে গেল, খাট থেকে পড়ে গেলাম, নিজেই খচমচ করে উঠে বললাম, তা-তার মানে?
খানিকটা তোতলামি এসে গেল। পা জখম হবার পর থেকে একটু তোতলাই। আজকাল প্রায় সেরে গেছে।
গুপি বলল, সে অনেক কথা।
বলে মুচকি হাসতে গিয়ে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল।
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। তারপর বললাম, পোড়া বউ মরেছে বুঝি?
গুপি মাথা নেড়ে বলল, পোড়া নয়। বউ নয়।
–তবে?
–ওঁর দাদা।
আমি বললাম, দাদা মরেছে তো তুই কাঁদছিস কেন? তাকে তো চিনিসও না।
গুপি বলল, মরেনি। সামন্ত তিনটে শকের কথা বলেছিল। ওই হল এক নম্বর।
তবে কেন কাদছিস্?
–উনি বর্মায় যাননি কখনো, জাহাজডুবি হয়নি, বাঁদরদের দ্বীপ থেকে কেউ তাড়ায়নি, ডুবো জাহাজে নেমে সোনা তোলেননি, বনের দেউয়ের পাহাড়ে ওঠেননি। ম্যাও নামে বেড়াল ছিল না। সব বানানো কথা। ওই হল দুনম্বরের শক্! ওঁর দাদা বলেছে।
তাই শুনে আমারও কেমন পেট কামড়াতে লাগল। তবে কি বউ রামু ডাকাতের মেয়ে নয়?
গুপি বলল, না, না, কারো মেয়ে নয়, বউই নয়, ও-ই দাদা।
কেমন গোলমাল লাগতে লাগল। কার দাদা?
–বড়ো মাস্টারের দাদা! মোটর চুরির ব্যাবসা ওঁর। ঠান্ডাঘরের মালিক উনি!
তারপর আরও খানিকটা কেঁদে বলল, স্পেসশিপ তৈরি হয় না ওখানে! চোরাই গাড়ির চেহারা বদলি করা হয়। বিনু তালুকদার সবাইকে ধরেছে। তাই কাল তার আসতে দেরি হল। এসে সব বলে গেল। তুই তখন হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লি! আজ আবার আসবে, তোর জবানি নেবে।
আমি বললাম, আ–আ–আমি কী কী–কী–কীসের বিষয় জবানি দেব?
গুপি অবাক হয়ে বলল, বেড়ালের।
–কী বেড়ালের জবানি?
–নেপো বেড়ালের।
আমি হাঁ করে তাকিয়েই রইলাম। নেপো ঘরে ঢুকে গুপিকে দেখে রেগে গর-র-র-গ র–র করতে লাগল। গুপি দুঃখিত হয়ে বলল, একরকম বলতে গেলে আমিই ওকে বাঁচালাম আর আমার উপর রাগ দেখাচ্ছে দেখো!
–না না, তোর উপরে ঠিক নয়। তুই আমার আলোয়ানের উপর বসেছিস কি না, ওইখানে ও বসে।
গুপি সরে বসে বলল, মাস্টারের দাদা অবসর সময় হার্মোনিয়ম বানাত। অনেক জায়গায় নাকি তার খুব চাহিদা। অনেক পয়সা কামাত।
আমি বললাম, কীরকম হার্মোনিয়ম?
গুপি অবাক হয়ে গেল। কেন, বেড়ালের হার্মোনিয়ম নিশ্চয়। নাকি সন্দেশ পড়ে শিখেছিল। খালি ওই বেড়াল ধরা যা একটা সমস্যা হয়েছিল। সব বেড়ালের সারেগামার সুর ঠিক থাকে না। সুর ঠিক না হলে লোকে কিনবে কেন। বেসুরো গান কে শুনতে চায়?