এমন সময় দরজা ঠেলে মেজোকাকু ঢুকেই, ওদের দেখে বললেন, এই যে তোমরা এখানে! ওটা কে? উঁদু না? তুই আবার দাড়ি রেখেছিস কেন? চেঁচে ফেল, বিশ্রী দেখাচ্ছে, স্রেফ আইন-ভঙ্গকারী! তোরা এখানে কী কচ্ছিস? এদিকে পাশের বাড়িতে বিনু তালুকদার যে কেল্লা ফতে করে দিয়েছে তাও জানিস না বুঝি? চাঁদু, এবার তুই বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত মনে পড়াশুনো করগে যা। বুড়ো বাপকে আর জ্বালাস নি।
গড়গড় করে কী যে বকছেন কাকু আমি ভালো করে বুঝতেই পারছিলাম না। কিন্তু গুপি আর ছোটোমামা কোনো কথা না বলে পাশাপাশি আমার খাটের উপর শুয়ে পড়ল। কাকু ব্যস্ত হয়ে রামকানাইকে বললেন, হাঁ করে বসে আছিস যে? ও-দুটোর দাঁতকপাটি লেগেছে দেখছিস না? মাথায় জলের ঝাপটা দে!
কিন্তু রামকানাইয়েরও এমনি হাত-পা কাঁপছিল যে সেও নড়তে পারছিল না। শেষপর্যন্ত আমিই তাক থেকে কুঁজো নামিয়ে জলের ঝাপটা দিতে লাগলাম। তাই দেখে কাকু আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, অ্যাঁ! তু-তু-ই হাঁটছিস্?
তাই তো, দিব্যি হাঁটাহাঁটি করছি, এতক্ষণ তো টের পাইনি! বাবাও এসে ঘরে ঢুকে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কেন জানি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম। বাবাও নাক টানতে টানতে আমার হাত ধরে আবার বসিয়ে দিলেন। পকেটে বোধ হয় চিপকে গিয়ে বিদ্যুৎ বকবকম করে উঠল। মা এসে কিছু না বলে মহা কান্নাকাটি লাগালেন। এ তো বড়ো জ্বালা।
অনেক পরে বাবা বললেন, ডাক্তারবাবুকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে, এখুনি আসবেন। বললেন এইরকম একটা উত্তেজনারই দরকার। কিন্তু এরা দু-জন এখনও ভিজে বালিশে শুয়ে কেন? সর্দি লাগবে না?
গুপি আর ছোটোমামার দু-জনারই সর্দির বড় ভয়। বাবার কথা শুনেই তড়াক করে উঠে বসে আমার তোয়ালে দিয়ে তারা মাথা মুছতে লেগে গেল।
তারপর বাবা মেজোকাকুকে বললেন, কী ব্যাপার খুলে বল দিকিনি।
কাকু বললেন, নিতাই সামন্ত এক্ষুনি এল বলে, এদের স্টেটমেন্ট নিতে। তার কাছেই সব শুনো। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গেছে। নিতাই ফোন করে বলল তোমার বাড়ি থেকে পাখি যেন না পালায়। তাই এলাম।
একথা যেই-না বলা, ছোটোমামা আর গুপি দু-জনাই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। মেজোকাকু বললেন, ও কী হচ্ছে? ওসব চলবে না। চুপ করে বসে থাকো। আমি কথা দিয়েছি সে না আসা অবধি তোমাদের এখানে আটক রাখব।
গুপি বলল, কী, কী করে জানলেন আমরা এখানে?
মেজোকাকু তো অবাক! কী করে জানলাম? শুধু আমি না, পাড়াসুদ্ধ যত লোক অন্ধকার গলিতে খাপে দাঁড়িয়েছিল, সবাই দেখেছে তক্তা পার হয়ে দু-জন আইনভঙ্গকারী এখানে আশ্রয় নিচ্ছে। খবরদার যদি নড়েছ!! আর সামন্ত আসার আগে ঠোঁট ফাঁক করবেনা। তোমরাই পুলিশের সবচেয়ে বড়ো সাক্ষী। ভিতরের ব্যাপার স্বচক্ষে দেখে এসেছ। ছোটো মাস্টার কোথায়? যাকগে, পুঁটিমাছ বোধ হয় বিনু তালুকদারের জালে পড়েছে।
এই বলে মেজোকাকু বেদম হাসতে লাগলেন। খুব রাগ হল!
তারপর গম্ভীর মুখ করে ছোটোমামার দিকে চেয়ে বললেন, তুমি সত্যি এর মধ্যে জড়িয়ে আছ দেখে বড় দুঃখিত হলাম। তোমার বাবা এত ভালো লোক, গেলেই কী ভালো তামাক খাওয়ান। তবে নিতাই সামন্ত যেই তোমার ঘরে চোরাই গাড়ির নম্বর প্লেট পেয়েছিল, তখনই সব আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি তুমি দুষ্টলোকের–
ছোটোমামা হঠাৎ রেগে গেলেন। ওসব আমি গোমেস ব্রাদার্স থেকে সের দরে কিনেছি, তার ভাউচার আছে মার হাতবাক্সে, গিয়ে দেখতে পারেন।
শুনে মেজোকাকু অবাক!
বাবা হেসে বললেন, ও হে, তোকে বলা হয়নি। চাঁদু যে স্পেসশিপ বানিয়ে গুপি আর পানুকে চাঁদে নিয়ে যাবে। সেখানে জমি কিনে ওরা স্পেসশিপ সারাবার কারখানা করবে। দ্যাখ চাদু, মাটির তলার জমি কিনিস কিন্তু, ওপরের জমি বাজে। হা কী বলছিলাম, তা চাদে যাবার খরচা কম নয়, ওরা পারবে কেন? তাই চাঁদু নিজেই স্পেসশিপ বানাবে। তাই নিয়ে এত ভাবতে হয় যে পড়া করার সময় পায় না। ফলে বি.এসসি.-তে সুবিধা করতে পারে না।
এই অবধি বলে বাবা আর মেজোকাকু যে-যার নিজের হাতঘড়ি দেখলেন। মেজোকাকু জানলার কাছে গিয়ে বললেন, দশটা বাজতে দশ মিনিট, আমাদের সকলের জন্যে রাঁধতে দিয়েছ আশা করি, বড়দা?
রামকানাই দরজার কাছ থেকে বলল, খিচুড়ি, মাংস, আলুভাজা, বেগুনভাজা।
গুপি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, ছি, মেজোকাকু, তোমার শুধু খাওয়ার ভাবনা।
গুপি আর ছোটোমামা একসঙ্গে বলল, খাওয়ার ভাবনা খারাপ নাকি? উঃ পেটে চড়া পড়ে গেছে!
ডাক্তারবাবু এলেন। আমার পা পরীক্ষা করলেন। হাঁটালেন, চলালেন, ওঠ-বোস করালেন! তারপর ওষুধপত্র মালিশের ব্যবস্থা করে দিয়ে বললেন, পানু, এও তোমার একরকম পরীক্ষা শেষ হল। তুমি খুব ভালো ভাবে পাস করেছ। এক মাস এক্সারসাইজ করবে, বাড়াবাড়ি করবেনা! তারপর স্কুলে যেতে পারবে। কেমন, খুশি তো?
আমার খুব সর্দি এসে গেল, কিছুই বলতে পারলাম না।
এমন সময় নিতাই সামন্ত এসে ঢুকলেন। সবাই চুপ।
মেজোকাকু একটু কেশে বললেন, এই যে কানু, তোমার সাক্ষী-সাবুদ, অনেক কষ্টে আটকে রাখা গেছে।
বাবা বললেন, তা ছাড়া অবিশ্যি দৌড়ঝাঁপ করার মতো ওদের ক্ষমতাও নেই।
ছোটোমামা ভাঙা গলায় বললেন, দু-দিন খাইনি। খাঁচায় বন্ধ করে রেখেছিল।