চাঁদ নিজের অক্ষ দণ্ডে ২৭ ১/৩ দিনে এক বার পাক খায়। পৃথিবীর চারদিকে ২৯ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটে এক বার ঘুরে আসে। চাঁদের ব্যাসের মাপ ৩৪৫৬ কিলোমিটার। মাঝে মাঝে চাঁদে রঙের পরিবর্তন দেখা যায়, তার কারণ সম্ভবত নিবে-যাওয়া আগ্নেয়গিরির গহ্বর থেকে গ্যাস বেরোয়।
এই অবধি পড়ে গুপি বইটাকে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে, ঘরময় পাইচারি করতে লাগল। দেখলাম মুখটা খুব লাল। বোধ হয় কান্না চাপছিল। ঠিক সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে ছোটো মাস্টার ফিরে এসে বললেন, গুপি, চল।
তারপর একটা ছোট্ট কার্ডে একটি গোপন টেলিফোন নম্বর লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, যদি দেখো রাত দশটার মধ্যেও আমরা কেউ ফিরে এলাম, তাহলে এই নম্বরে ফোন করে শুধু বলবে–ফু-মন্তর, ব্যস্ আর কিছুনয়। কার্ডটি তখুনি ছিঁড়ে ফেলো আর কখনো কাউকে বোলো না। বলিওনি কাউকে, তা ছাড়া এখন ভুলেও গেছি। অবিশ্যি ফোন করার দরকার-ও হয়নি। কার্ডটাকে ছিঁড়েও ফেলেছি।
ওরা চলে গেলে পর আমার নানান কথা মনে হতে লাগল। পা দুটোর উপর এমনি রাগ হতে লাগল যে আর কী বলব। তার উপর রামকানাই এসে ইনিয়েবিনিয়ে ওর পিসেমশাইয়ের কত বার কী অসুখ হয়েছিল তাই বলতে লাগল। ওকে বললাম, জান, নেপো বেঁচে আছে।
রামকানাই তো অবাক। ওকী কথা পানুদা, যারা অনেকদিন সঙ্গ ভোগ করছে, তাদের বিষয় অমন কথা বলতে হয় না। অবিশ্যি সঙ্গ কি না সে বিষয়েও ঠিক বলা যায় না।
আমি বললাম না, রামকানাইদা, না। নেপো ছাড়া কে বিদ্যুতের পালক ছাড়িয়েছে বলো। বুক পকেট থেকে বিদ্যুৎকে বের করে দেখালাম। রামকানাই তো হাঁ।
হঠাৎ বড়ো মাস্টারের জানলার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। ঘরে আলো জ্বলছে না। এই বাড়িতে আমরা চার বছর আছি, কখনো ও-ঘর অন্ধকার দেখিনি। যেই-না সূর্য ডোবে ও-ঘরেও বাতি জ্বলে। একবার অনেকক্ষণ পাড়ার আলো নিবে গেছিল। নেবার সঙ্গেসঙ্গে ও-ঘরে মোমবাতির আলো দেখতে পেয়েছিলাম। বউ বোধ করি অন্ধকারকে ভয় পায়। অথচ একদিন ওই বউই বনে বাস করত।
জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম ছাপাখানার আর ঠান্ডাঘরের কোনো আলোই জ্বলছে না। নীচে বড়ো মাস্টারের নাইট স্কুলের শেডের সামনের বড়ো আলোও নেবানো। কোথাও একটা লোক দেখা যাচ্ছে না। তবু আমার ঘরে বসেই টের পাচ্ছিলাম যে ওই দুটো বাড়িতে সাংঘাতিক কিছুএকটা পাকিয়ে উঠছে।
রামকানাইকে বললাম, তুমি এক বার যাও-না, গুপি আর ছোটো মাস্টারের সাহায্য দরকার হতে পারে।
রামকানাই ফোঁস করে উঠল, ও বাবা, সে আমি পারব না। কেউটে সাপের বাসায় নাক গলানো আমার কম্ম নয়। তা ছাড়া আমি গেলে তোমার দেখাশুনো করবে কে! তোমাকে একা ফেলে যাই, আমার চাকরিটাও যাক আর কী। যাই, মাংসটা চাপিয়ে এসেছি। এই বলে রামকানাই সত্যি সত্যি দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
দরজার কাছে পৌঁছে, ফিরে বলল, কোনো ভয় নেই, ওই যে সামন্তবাবুও একদল প্যায়দা নিয়ে গলিতে ঢুকল। যাই, মাংস না ধরে যায়। চোর ধরার চেয়ে সে অনেক খারাপ হবে।
আরও অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। রামকানাই একবার উঁকি মেরে দেখতে এল কী করছি। বললাম, সব শুনেও নেপোকে খুঁজতে যাবে না?
রামকানাই বলল, না, আমার গুরুদেব শুনলে দুঃখিত হবেন! এই বলেই চলে গেল। একটু পরে আবার এসে বলল। অত নেপো-নেপো করো কেন? মহা পাজি বেড়াল। অমন ঢের ঢের বেড়াল পাওয়া যায়। চাও তো দুটো-একটাকে এনেও দিতে পারি। চাঁদের বইটা ছুঁড়ে মারলাম। সঙ্গেসঙ্গে সে কী চিৎকার!! শুনে আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠল। মনে হল কে চাঁচাচ্ছে, পানু পানু পানু ওরে পানু– বাঁচা– রে! মি–অ্যাঁ–ও মি–অ্যাঁও। আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলাম না, পাঁই পাঁই গাড়ি চালিয়ে একেবারে পেছনের বারান্দার ঘোরানো সিঁড়ির মুখের কাছে চলে গেলাম। মনে হল ওদিকে ওদের ঘোরানো সিঁড়ির মাথার দরজাটায় কারা যেন আছড়ে পড়ল। পানু পানু বাঁচা। আর সে কী মাও-মাও শব্দ।
–ও রামকানাই দা! ও রামকানাই দা! বলে চাঁচাতে লাগলাম। উত্তর নেই। হঠাৎ দেখি রঙের মিস্ত্রিদের তক্তাটা আমাদের রেলিঙের ধারে পড়ে আছে। এক মাথা সিঁড়ির রেলিঙে বাঁধা। নিশ্চয় গুপির কাজ। হাত বাড়িয়ে সেটাকে তুলে নিলাম। বেশ ভারী। গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ির রেলিঙের ফঁক দিয়ে ঠেলে ঠেলে যেই-না ওদের সিঁড়ির সঙ্গে জুড়ে দিলাম, অমনি ওদিকের দরজা খুলে হুড়মুড় করে দাড়িওয়ালা একটা লোক বেড়াল বগলে তক্তা পেরিয়ে চলে এল। সঙ্গেসঙ্গে গুপি এসেই তক্তা টেনে নিল। কিন্তু ততক্ষণে আরও গোটা দশেক বেড়াল আমাদের বারান্দায় এসে উঠেছে। উঠেই কার্নিশ বেয়ে হাওয়া।
আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম। এবার উঠে গাড়িতে চেপে খাবার ঘরে এলাম। গুপি বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি কেবল বলতে লাগলাম, ওরে নেপো! আবার ফিরে এসেছিস!আর নেপো আমার কোলে উঠে কেবলই আমাকে চাটতে লাগল। নেপোর গলায় দেখলাম একটা সাদা টিকিট ঝুলছে। তাতে লেখা—A।
ছোটোমামা আর গুপি আমার বিছানায় বসে বসে খালি হাঁপাতে লাগল। তাদের মুখগুলো কাগজের মতো সাদা, হাত-পা কাঁপছে।
রামকানাইকে কিছু না বলতেই ওদের জন্যে গরম চা আর নেপোর জন্যে বাটি করে দুধ নিয়ে এল। টানতে টানতে নেপোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে দুধের বাটির সামনে বসিয়ে দিল এবং বলা বাহুল্য নেপোও তৎক্ষণাৎ দুধের সদ্ব্যবহার করতে লেগে গেল।