আমি চমকে উঠলাম। সে কী! তাহলে কি ছোটোমামা। নাঃ, উনি তো রাতে বেরুতে ভয় পান।
ছোটো মাস্টার হাসলেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে ভয়-ডর টেকে না, তাও জান না। ভদ্রলোক কোনোরকম বিপদে-টিপদে পড়েননি তো? এক রকম আমার কথাতেই চোঙায় সেঁদোলেন। আচ্ছা আজ ঠকঠক শব্দটব্দ কিছু শুনেছ কি?
তাই তো! আজ তো ঠান্ডা ঘর একেবারে চুপ। তাকিয়ে দেখলাম বড়ো মাস্টারের নাইট স্কুলের শেডে একটা নোটিস লটকানো রয়েছে!
ছোটো মাস্টার বললেন, আজ স্কুল বন্ধ। বড়ো স্যারের বাড়িতে নাকি কী গোলমাল হয়েছে। বউটিকে কিন্তু বড়ো বদমেজাজী মনে হয়। যদিও খাসা রাঁধে। ঙাপ্পি খেয়েছ কখনো?
আমি বললাম, ওয়াক্ থুঃ!
ছোটোমাস্টার চটে গেলেন। ও আবার কী হল? যে-জিনিস সম্বন্ধে কিছু জান না, তাকে ওয়াক থুঃ করার কোনো মানে হয় না। খুব ভালো জিনিস। এক থালা ভাতে এক চিমটি মাখলেই অমৃতের মতো লাগে। বড়ো স্যারের নিজের মুখে শোনা। ছাদের ঘরে ওঁর বউ ঙাপ্পি বানায়। ফুলের টবের মাটিতে পুঁতে রাখে। একদিন একটু চেয়ে নেব।
তারপর ছোটো মাস্টার যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বললেন, নাঃ, মনটা বড়ো খুঁতখুঁত করছে। গুপির দূরবিনটা দাও তো একটু দেখি।
অনেকক্ষণ দেখলেন। সব ভোঁ-ভাঁ। ছাদে সেই ছোটো ছোটো সাদা কালো জানোয়াররাও চরছে, তা সে পেঙ্গুইন-ই হোক, কি বেড়ালই হোক। শেষটা দূরবিন নামিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ছোটো মাস্টার চলে গেলেন।
যেই-না সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়েছেন, দরজা তখনও ভালো করে বন্ধ হয়নি, খাবারঘরের মধ্যে দিয়ে গুপি এসে হুড়মুড় করে ঢুকে বলল, পানু, সর্বনাশ হয়েছে!
১০.
গুপি পকেট থেকে কিলবিলে গোলাপি রঙের কী একটা বিশ্রী জানোয়ার আমার কোলের উপর ফেলে দিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবলি হাঁপাতে লাগল। আমার তো চক্ষুস্থির। মনে হল নতুন ধরনের ব্যাং। আমি আবার ব্যাং দেখতে পারি না। তাই বলে যে ভয় পাই তা যেন কেউ মনে না করে। খুদে একটা গোলাপি ব্যাং; তাও যদি মস্ত পায়রাখেকো ব্যাং হত। ফেলেই দিচ্ছিলাম কোল থেকে, এমন সময় ছোটো মাস্টার আবার ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ওর পায়ে বাঁধা ওটা কী?
বলে আমার কোল থেকে ব্যাংটাকে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। বাঁ-পায়ে ছোট্ট একটা অ্যালুমিনিয়ামের খাপের মতো। ব্যাংটা থরথর করে কাপছিল। মাঝে মাঝে কালো ঠোঁট দুটো খুলছিল আর বন্ধ করছিল। ভারি অদ্ভুত লাগল। ব্যাঙের আবার ঠোঁট হয় জানতাম না।
গুপি গোল গোল চোখ করে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, বলল, ওটা ব্যাং নয়, ও আমাদের বার্তাবাহী পায়রা, বিদ্যুৎ। বলে কী! পায়রা কখনো ব্যাঙের মতো হয়? গুপি বলল, হয় হয়। সব জানোয়ারের নোম ছাড়ালেই ব্যাঙের মতো। মানুষও। আমার ছোটো বোনটা একেবারে ব্যাঙের মতো, শুধু একটু বড়ো, এই যা।
ছোটো মাস্টার ততক্ষণে পায়ের খাপটা খুলে ছোটো একটা চিঠি বের করে ফেলেছেন। চিঠি খুলে চমকে উঠে সেটা গুপিকে দিলেন। গুপিও চিঠি পড়ে দারুণ ব্যস্ত হয়ে উঠে, আমাকে দিল। দেখি ফিকে পেনসিল দিয়ে লেখা, গুপে চলে আয়। লোমহর্ষক ব্যাপার। নামটাই নেই।
ছোটো মাস্টার বললেন, চাঁদুর লেখাই তো?
গুপি বলল, সে আর বলতে হবে না। অমন খারাপ হাতের লেখা আর কার হবে?
ছোটো মাস্টার বললেন, কিন্তু কোথায় চলে যেতে হবে? একেবারে শত্রুর খপ্পরে পড়ে যাবি না তো? ওরা যদি চিঠির কথা না-ই জানবে তো পায়রার পালক ছাড়াল কে?
গুপি বলল, তাই তো, যে পালক ছাড়িয়েছে, সেখাপটাকেও দেখেছে। আর খাপ দেখেছে যখন তখন কি আর চিঠি খুলে পড়েনি। পড়ে আবার খুঁজে রেখেছে। যাতে সবাইকে একসঙ্গে ধরতে পারে। কে জানে ছোটোমামা এতক্ষণ বেঁচে! গুপি থেমে গিয়ে মুখ ঢাকল। হঠাৎ আমি হেসে উঠলাম। ওরা তো অবাক।
ছোটো মাস্টার ভারি বিরক্ত হয়ে বললেন, একটা মানুষের মরণ-বাঁচন সমস্যা আর তোমার কি না হাসি পাচ্ছে!
খুব লজ্জা পেয়ে বললাম, না, না, সেজন্যে নয়, তা ছাড়া ছোটোমামা যে সহজে মরবেনা সেটা ঠিক। আমি হাসছিলাম কারণ নেপো যে বেঁচে আছে সেটা এবার প্রমাণ হল। পাখি ধরতে পারলেই ও তাদের পালক ছাড়ায়। পায়রা যেখান থেকে এসেছে, সেখানে নেপোও আছে।
গুপি বলল, তার মানে সেখানে ছোটোমামাও আছে। চলুন, ছোটো স্যার, তাকে উদ্ধার করতে হবে। বিপদ-আপদ দেখলে ছোটোমামার দাঁতকপাটি লেগে যায়।
ছোটো মাস্টার কাষ্ঠহেসে বললেন, তাহলে চাঁদে যাবার খুবই উপযুক্ত পাত্র দেখছি। তুমি বরং এগোও, আমি একটু কাজ সেরে আসছি।
গুপি বলল, কার কত সাহস বোঝাই যাচ্ছে।
ওই ওর দোষ, অল্পতেই রেগে যায়।
ছোটো মাস্টার কিছু মনে করলেন না। তা ছাড়া বড়ো মাস্টারের কাছে তো দিন-রাতই এই ধরনের কথা শোনেন। নরম গলায় বললেন, মন্দ বলনি। দু-জনে গেলে বেশি কাজ দেবে। তাহলে তোমরা এখানে একটু অপেক্ষা করো, আমি কাজ দুটো সেরে আসি। ততক্ষণে এই বইটা থেকে চাঁদের বিষয়ে আরও কিছু তথ্য শেখো, কেমন?
এই বলে ছোটো একটা বই আমার হাতে দিয়ে ছোটো মাস্টার একরকম ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
ভারি ভালো বইটা। নাম চাঁদের রহস্য। খুলে দেখলাম লেখা রয়েছে সম্ভবত সাড়ে চার-শো কোটি বছর আগে গ্যাস আর ধুলো একসঙ্গে জমে চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল, এইরকম মত কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ পোষণ করে থাকেন। অর্থাৎ চাঁদ পৃথিবীর চেয়েও পুরোনো। কেউ কেউ আবার বলেন পৃথিবীর টুকরো ছিঁড়ে উড়ে গিয়ে উঁদ তৈরি হয়েছে।