ছোটো মাস্টার বললেন, না, না, কোন কথাটা আমি তাকে বলেছি? তবেচাদুকে তাড়াতাড়ি চাদে যেতে বল। কারণ সত্যিই এ-বছরেই অ্যামেরিকানরা গিয়ে হয়তো সেখানে ব্যাবসা কঁদবে। তারপর পারমিট পাওয়াই এক মহা সমস্যা হবে।
ছোটো মাস্টার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে, গুপি বলল, নারে পানু, কাজটা খুব ভালো হল না। ছোটোমামা চোঙায় ঢুকতে গিয়ে না আবার কোনো ফ্যাসাদে পড়ে। সাহসী হলে কী হবে। মাকড়সা, টিকটিকি, এমনকী ব্যাং দেখলেও ওর হাঁটু বেঁকে যায়। শেষটা চোঙায় ঢুকে না আটকে থাকে। তা ছাড়া ছোটো মাস্টার কী করে ছোটোমামার ডাকনাম জানল? নিশ্চয় তোদের কাছে শুনেছে। তোরা বড় কথা বলিস। এসব ব্যাপারে ছোটো মাস্টারের এত কীসের মাথাব্যথা তা বুঝলাম না।
গুপি চলে গেলে, অনেকক্ষণ বসে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম বড়ো মাস্টার হাত নেড়ে বউকে কী বোঝাচ্ছেন আর বউ ঘন ঘন মাথা নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে। কিছুদিন আগে বড়ো মাস্টারের বউ পোড়ার লোমহর্ষক কাহিনি শুনেছিলাম। বড়ো মাস্টার-ই বলেছিলেন। ঠিক যেন পরিদের গল্প। বর্মার ঘন জঙ্গলে বড়ো মাস্টারের বাবা সেগুন গাছের ইজারা নিয়েছিলেন। সেখানে যত সেগুন গাছ ছিল সব তার কেটে আনার অধিকার ছিল। কিন্তু বনে গিয়ে সে গাছের শোভা দেখে আর কাটতে ইচ্ছা করত না। ভাবলেন তার চাইতে বড়ো বড়ো ডাল কেটেও তো কাজ চালানো যায়।
সারাদিন বনে বনে ঘুরেছেন। সঙ্গের লোকেরা অনেক ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিক ছায়া-ছায়া থমথম করছে। লোকের মুখে শোনা নানারকম ভয়ের গল্প মনে পড়ছে। তার উপর ওই বনে বিখ্যাত ডাকাতের সর্দার রামুর কথাও মাঝে মাঝে কানে আসত। মাস্টারমশাইয়ের বাবা ভাবছিলেন অশরীরীদের চেয়ে বরং ডাকাতের সর্দারই ভালো। এমন সময় করুণ কান্নার শব্দ কানে এল।
মাস্টারমশাইয়ের বাবা চমকে উঠলেন। তীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধি থাকলেও, মনটা তাঁর বড়ো নরম ছিল। কান্না শুনে আর থাকতে না পেরে খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিলেন। হঠাৎ মনে হল তারই একটা সেগুন গাছের তলা আলো করে কে যেন বসে হাপুসনয়নে কাঁদছে। কাছে গিয়ে দেখেন সাত-আট বছরের একটি ছোট্ট সুন্দর মেয়ে, দুধে-আলতা গায়ের রং, আঙুরের থোপারমতো কোঁকড়া চুল। কার মেয়ে কোথায় বাড়ি কিছু বলতে পারে না।
জিজ্ঞাসা করলেই মা-মা বলে কাঁদে।
বাবা তাকে অভয় দিয়ে, সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এলেন। মাস্টারমশাইয়ের মা ছিলেন না, কিন্তু বুড়ি পিসি ছিলেন। তিনিই অনেক যত্নে ওই মেয়েটিকে মানুষ করে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। সবাই তখন মানা করেছিল, বলেছিল বন থেকে কুড়িয়ে-আনা মেয়ে, কে জানে দৈত্যদানোর ঘরের কি না। কিন্তু পিসিমা কারো কথা শোনেননি।
তারপর বউয়ের একটু বয়স হলে রাতে বাড়িতে নানান উপদ্রব হতে লাগল। বাইরে থেকে কারা গোরু-ছাগল চুরি করে। কারা যেন ছোরা ছুঁড়ে মারে। শেষটা বউ একদিন আর থাকতে না পেরে সব ফাঁস করে দিলে। সে আসলে রামু ডাকাতের নাতনি। রামুই ওকে বনের মধ্যে ওইভাবে ফেলে রেখেছিল। যাতে বড়ো হয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাবার বাড়ি থেকে ধনরত্ন নিয়মিত পাচার করতে পারে। এইরকম অনেক ছেলে-মেয়েকে রামু এবাড়ি-ওবাড়ি পাচার করে, ফলাও করে ডাকাতি ব্যাবসা চালাত। এতে করে মাসে গড়ে হাজার দুই উপায় হত।
কিন্তু মুশকিল হল যে পিসির উপর মাস্টারমশাইয়ের বউয়ের বড়ো টান। কিছু পাচার করা দূরে থাকুক, এতটুকু শব্দ শুনলেই হাউমাউ করে ওঠে। শেষে ওর জন্যেই দলের দু-চারজন ধরাও পড়ল। তখন রামুর দল ওদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সে অঞ্চল থেকে সরে পড়ল। ওই আগুনে জিনিসপত্রের অনেক ক্ষতি হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রাণে কেউ মরেনি। দুঃখের বিষয় বউয়ের মুখের এক দিকটা ঝলসে গেছিল। সেই অবধি বউ আর কারো সামনে বেরোয় না। কিন্তু পিসিদের বাঁচাতে গিয়েই বউয়ের এই দশা, তাই হাজার খিটখিটে হলেও মাস্টারমশাই ওর যত্ন করেন। পিসি তো ওর কোলেই মাথা রেখে নব্বই বছর বয়সে স্বর্গে গেছেন।
গল্প শুনে গুপির আর আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। বউয়ের জন্যে গুপি কিছু ফুল এনে দিয়েছিল। মাস্টারমশাই খুব খুশি হয়েছিলেন মনে হল।
তবু রোজ রোজ এত কীসের তর্কাতর্কি ভেবে পেলাম না। আগে এমন ছিল না। জানলা দিয়ে শুধু বউয়ের ঘোমটাপরা মাথাটুকু দেখা যেত। আজকাল মনে হয় বেশ ঘুসি পাকিয়ে মাস্টারমশাইকে ভয় দেখাচ্ছে।
তার পরদিন বিকেলে ছোটো মাস্টার আমাকে হাতের কাজ শেখাতে এসে বললেন, চাঁদে যাবার রকেটের এই মডেলটা বানিয়েছি দেখো।
আমি তো অবাক। সব আছে দেখলাম। লঞ্চিং প্যাড পর্যন্ত। নাকি সত্যি ওড়ানো যায়। তবে খোলা জায়গা দরকার।
আমি বড়ো মাস্টারের ঘরের সামনে খোলা ছাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওইখানে যেতে পারলে বেশ হত।
ছোটো মাস্টার একটু যেন থতমতো খেয়ে গেলেন। হঠাৎ বললেন, ছোটোমামার কাছ থেকে কি কোনো খবর আসেনি?
আমি বললাম, না তো।
–মানে তিনি আছেন তো?
আমি আঁতকে উঠলাম। আছেন তো আবার কী? কতসময় তাকে দিনের-পর-দিন দেখা যায় না। ইচ্ছা করেই উনি গা ঢাকা দিয়ে থাকেন, যাতে পুলিশের নজরে না পড়েন।
ছোটো মাস্টার হাত থেকে মডেলটা নামিয়ে রেখে বললেন, কিন্তু চোঙার মুখের ঢাকনিটা কাল রাত থেকেই খোলা।