এই অবধি বলে, পা ঠুকে বড়ো মাস্টার হেসে বললেন, তাতে কোনো দুঃখ নেই, একটু সময় পেলেই নিজের জীবনের সত্যিকার অভিজ্ঞতাগুলো লিখে ফেলব। প্রকাশকরা দু-পাতা পড়লেই লুফে নেবে। তখন আমার আবার লাখপতি হওয়া ঠেকায় কে! তোকেও কিছু টাকা দেব।
মাস্টারের বাঁ ঠ্যাং হাঁটুর নীচে থেকে কাটা। তার জায়গায় চামড়ার স্ট্র্যাপ আর বগলেস দিয়ে একটা কাঠের ঠ্যাং আঁটা। দেখতে অনেকটা টেবিলের পায়ার মতো। মাঝে মাঝে গল্প বলতে বলতে বেশি হাত পা ছুড়লে সেটা ফস করে বেরিয়ে আসে। অনেক কষ্টে আবার পরাতে হয়; আমরা সাহায্য করি, মাস্টার ঘেমে নেয়ে ওঠেন। নাকি বড় লাগে। অনেক দিন আগে নাকি প্রশান্ত মহাসাগরে বাকি পাটা হাঙরে খেয়েছিল। অনেক কষ্টে দু-মাইল সাঁতরে তবে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তা-ও বাঁচতেন না; ভাগ্যক্রমে হঠাৎ শোঁ শোঁ করে সাইমুন ঝড় উঠল, তিন তলার সমান ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল! প্রাণের ভয়ে শিকার ছেড়ে হাঙর সমুদ্রের তলায় ডুব দিল। অবিশ্যি ঠ্যাংটা সঙ্গে নিতে ভুলল না। বড়ো মাস্টার খোলামকুচির মতো ঢেউয়ের সঙ্গে উঠতে পড়তে লাগলেন।
ভাগ্যিস একটা বড়ো তেল ট্যাঙ্কারের দয়ালু কাপ্তেন ঠিক সেই সময় তাঁকে দেখতে পেয়ে, পঞ্চাশ মণ তেল ঢেলে ঢেউ শান্ত করে, তাকে জাহাজে টেনে তুলেছিলেন, নইলে সেযাত্রা হয়ে গিয়েছিল আর কী! এ ঠ্যাংটা আসলে ওই জাহাজেরই রান্নাঘরের একটা ভাঙা টেবিলের পায়া। নাবিকদের দয়ার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপে মাস্টার ওটাকে এখনও রেখেছেন। নইলে ছাপাখানার বড়ো সাহেবের চিঠি নিয়ে গেলে সস্তায়, এমনকী হয়তো বিনি পয়সাতেই, কত ভালো ভালো ঠ্যাং কিনতে পাওয়া যায়, অ্যালুমিনিয়মের কাঠামোর উপর রবার দিয়ে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। সত্যিকার পা থেকে দেখতে কোনো তফাত নেই। বরং ঢের ভালো, আলপিন ফুটলেও টের পাওয়া যায় না। তবে এই টেবিল-পায়ার ঠ্যাংটাই-বা মন্দ কি? বন্ধুদের দান!
এই বলে বড়ো মাস্টার আমার যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে লম্বা একটা পেরেক নিয়ে কেঠো পায়ের গোড়ালির কাছে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে নিলেন। নাকি বোলতায় গর্ত করেছিল। পরে মাস্টার কেঠো পায়ের গুলির কাছে ছোটো একটা দেরাজ করে নেবেন; তাতে পয়সাকড়ি রাখবেন, কাকপক্ষীও টের পাবে না। যা পকেটমারের দাপট আজকাল! বড়ো মাস্টার চলে গেলে গুপি পকেট থেকে কাগজে-মোড়া একটা মলাট-ছেঁড়া বই বের করল। বইটার নাম পুষ্পক থেকে প্লেন। গুপির ছোটোমামার বই। অনেক কষ্টে জোগাড় করা। আশ্চর্য সব বই আনে গুপি। মঙ্গলের মানুষ, বুধে বিপত্তি, চন্দ্রনাথের চন্দ্রযাত্রা, এইসব। একটা টাইমমেশিনের বই এনেছিল; ওই মেশিনে চেপে অতীতে ভবিষ্যতে যে সময়ে ইচ্ছা যাওয়া-আসা যায়। পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। তা ছাড়া কলের মানুষের গল্প আনে, তাদের রোবো বলে।
এইসবই আমাদের ভালো লাগে। আমরা বড়ো হয়ে প্রথমেই চাঁদে যাব। গুপির ছোটোমামা নাকি চাঁদে জমি কিনবেন। সেখানে ছোটো একটা বাড়ি করবেন, তাতে মেশিনে রান্না হবে। তাহলে তো আমাদের সেখানে গিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। খালি তার আগে আমার পা দুটোকে সারিয়ে নিতে হবে। এদিকে ছোটোমামা বি.এসসি. পাস করেই মহাকাশযান বানাতে শিখবেন। এখন থেকেই তার জন্যে টিন, অ্যালুমিনিয়ম, রবার, বন্টু এইসব জমাচ্ছেন।
০২.
এর মধ্যে আবার গুপির জন্মদিন করা গেল। আমার ঘরে; ভজুদা আর বড়ো মাস্টারমশাইকে নেমন্তন্ন করা হল। সেদিন ছিল রবিবার, আমাদের বাড়ির সবাই বিকেলে চা খাবার পর অন্যান্য রবিবারের মতো দাদুর বাড়ি চলে গেল। খুব ভালো চা হয়েছিল; কোকা-কোলা, ছাঁচি পান, মাংসের শিঙাড়া, আলু নারকেলের ঘুগনি, আইসক্রিম। গুপিদের বাড়িতে কারো জন্মদিন হয় না। গুপির দাদু বলেন জন্মদিন করলেই নাকি লোকেরা মারা যায়। অথচ ওঁরা কারো জন্মদিন করেন না, তবু ওঁদের পূর্বপুরুষেরা কেউ বেঁচে নেই। তার মানে জন্মদিন না করলেও লোকেরা মরে।
ভজুদার কাজকর্ম সেরে অনেক দেরি করে আসার কথা। প্রথমে গুপি এসেই চাঁদের যাত্রী বলে দু-টাকা দামের একটা চমৎকার বই আমার হাতে দিল। আমি ওই বইটা আর বালিশের তলা থেকে দুটো টাকা নিয়ে গুপিকে দিলাম। ওর জন্মদিনের উপহার। প্রথম পাতায় লিখে দিলাম, চাঁদের যাত্রীকে জন্মদিনে চাঁদের যাত্রী দিলাম, ইতি, চাঁদের যাত্রী। বেশ হল-না?
গুপির ঠাকুরদা এসব বইয়ের উপর হাড়ে চটা। তিনি একসময় জাহাজে চাকরি করতেন। গুপি বলে পৃথিবীতে হেন সাগরতীর নেই যেখানে ওর ঠাকুরদা যাননি। এমনসব অদ্ভুত জিনিস তাঁর নিজের চোখে দেখা যে তিনি আর কল্পনায় বিশ্বাস করেন না। অবিশ্যি অত বড়ো চাঁদকে কিছুকল্পনার জিনিস বলা যায় না। আবহমান কাল থেকে লোকে তাকে দেখে আসছে, তার টানে সমুদ্রে জোয়ার উঠছে; রাশিয়ানরা আমেরিকানরা সেখানে রকেট নামিয়েছে পর্যন্ত; এইসব ছবি দিয়েই চন্দ্রযাত্রী বইটার পাতার পর পাতা ভরতি। যেখানে গাড়ি-ঘোড়া নামানো যায়–আর রকেটকে গাড়ি-ঘোড়া ছাড়া আজকাল আর কী বলা যায়? যেখানকার ডাঙায় যন্ত্র নামিয়ে ফোটো তুলে পাঠানো যায়, সে এই পৃথিবীটার চেয়ে কোন দিক দিয়ে বেশি কাল্পনিক হল তা ভেবে পাওয়া যায় না। মোটেই পৃথিবীর সব জায়গার ফোটো তোলা হয়নি।