গুপি বলল, না, না, ছোটোমামা তোমার সবতাতেই ইয়ে। উনি তোমার বিষয়ে কিছু জানেন না। তা ছাড়া জানলেও কেউ তোমাকে এখন চিনতে পারবে না।
ছোটোমামা খুশি হয়ে দাড়ি চুমরোতে চুমরোতে বললেন, চিনতে পারবেনা, না? বাব্বা, ক্যায়সা ছদ্মবেশটা ধরেছি তাই বল! ছোটো মাস্টার ছেড়ে দে, সে তো আমাকে আগে কখনো দেখেইনি, আমার নিজের বাবাই চিনতে পারবে না দেখিস। ভাবছি লোহালক্কড়গুলো কিছু কিছু নিয়ে এসে কাছে রাখি। পানু, তোর খাটের তলায় কিছু রাখলে তোর আপত্তি আছে?
আমি তো মহা মুশকিলে পড়লাম। সেই যে নিতাই সামন্ত চোরের কথা বলে গেছিল, সেই ইস্তক রোজ রাতে মা একটা বেঁটে লাঠি দিয়ে আমার খাটের তলা খুঁচিয়ে দেখেন। অথচ ছোটোমামা যদি ভাবেন আমি ওঁকে সাহায্য করতে চাইনা, তা হলে চাই কী হয়তো চাঁদের দল থেকে আমার নামটাই ছাঁটাই করে দেবেন। তাই বললাম, ইয়ে কী বলব, মানে, ইয়ে–
গুপি বলল, না, না এখানে নিতাই সামন্তর বড়ো বেশি আনাগোনা। কে ওদের এক টিকটিকি এসেছে দিল্লি থেকে, সে শুঁকে শুঁকে ফেরারি আসামি বের করে দেয়।
ছোটোমামা চটে গেলেন, আমি ফেরারি হতে পারি, কিন্তু মোটেই আসামি নই। একটু তাড়াতাড়ি চাইছিলাম কারণ অ্যামেরিকানরা এর মধ্যে তিনটে লোক পাঠিয়ে চাদে বেড় দিয়ে এসেছে, এবার নাকি লোক নামাবে। এর পরে আর ওখানে জমিটমি পাওয়াই যাবে না।
গুপি বলল, আমাদের হেডস্যার বলেছেন যে রাশিয়ানরা হয়তো এর আগেই ওখানে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে।
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, হ্যাঁ, আমি তোর দূরবিন দিয়ে স্পষ্ট দেখেছি, জিনিস বোঝাই নৌকো চাঁদে যাচ্ছে।
গুপি বলল, না রে না, দূরবিনের কাচে কে একটা ছোট্ট খেলনা আটকে দিয়েছে, তাতে খুদে একটা নৌকো জলের মতো জিনিসে ভাসে, মনে হয় বুঝি সত্যি! কিন্তু অ্যামেরিকানরা চাদে নেমে যদি দেখে রাশিয়ানরা আগেই সেখানে ঘরবাড়ি করে ফেলেছে, তাহলে বেশ মজা হয়।
এমনি সময় ছোটো মাস্টার আবার ফিরে এসে মোড়ায় বসেই বললেন, চোঙা লোহার ঢাকনি দিয়ে কে বন্ধ করে দিয়েছে। ওই দিক দিয়ে ঢোকা যাবে না।
ছোটোমামা চমকে উঠে বললেন, কেন ঢোকা যাবে না? কিন্তু ঢুকবে কে?
ছোটো মাস্টার ছোটোমামার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন, রোগাপানা সাহসী কেউ ঢুকবে।
ছোটোমামা বললেন, খুব বেশি রোগা হওয়া চাই নাকি?
ছোটো মাস্টার কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, আমার চেয়ে রোগা কেউ। দাড়ি থাকলে ক্ষতি নেই। বরং চোঙার ভেতরে নরম লাইনিং-এর কাজ করবে।
ছোটোমামা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাবা দাড়ি রাখা পছন্দ করেন না, ওটা চেঁচে ফেলব ভাবছি।
ছোটো মাস্টার বললেন, বাবা তো শুনেছি পড়াশুনো ফেলে, লোহালক্কড়ের সন্ধানে ঘোরাও পছন্দ করেন না। তবে সাহস না থাকলে কেই-বা চোঙার মধ্যে ঢুকবে বলুন? কোথায় কী আছে কে জানে।
ছোটোমামা উঠে পড়েছিলেন, আবার বসে পড়ে বললেন, কী আবার থাকবে? স্পেসশিপের গুপ্ত কারখানা আছে। বাইরের লোক ঢুকলে মাথায় হয়তো স্প্যানার মারবে।
ছোটো মাস্টার বললেন, কিন্তু বেড়ালরাও ছিল মনে রাখবেন। একাজে বেড়ালের চেয়ে মানুষ পেলে অনেক ভালো হয় না কি?
ভালো করে ওদের কথার মানে বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু দেখলাম ছোটোমামার চোখ দুটো হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল। কীরকম চাপা গলায় বললেন, মানুষ। চাদে নামার প্রথম মানুষ! ই-স্! একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা বাঁকিয়ে বললেন, কিন্তু লোহার ঢাকনি আঁটা বললেন যে?
ছোটো মাস্টার বললেন, আহা, বাইরে থেকে রিভেট করা। ওস্তাদ লোকের পক্ষে সে আর এমন কী। তা ছাড়া আমার মনে হয়–
ছোটোমামা বললেন, কী মনে হয়?
–আজ রাতে রিভেট ভোলা থাকতেও পারে। যা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
ছোটোমামা বললেন, চলি। এবেলা ডিউটি আছে।
কেমন যেন ওঁকে দেখতে অনেক লম্বা অনেক ষণ্ডা অনেক লোমশ মনে হচ্ছিল। আমার শার্ট প্যান্ট পরেই চলে গেলেন। উৎসাহের চোটে আমার পায়ে বেজায় ঝিঁঝিধরে গেল। অথচ দশ দিন আগেও পায়ে কিছু টেরই পেতাম না। শেষটা হয়তো চাদে গিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। এই সময় ছোটোমামা ফিরে এসে বললেন, একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। গুপি, শোবার সময় জানলা একটু খুলে রাখিস। তেমন তেমন হলে, পায়রা গিয়ে খবর দেবে। বলেই সুড়ৎ করে চলে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে গুপির দিকে চাইলাম।
গুপি বলল, আমরা কয়েকটা পায়রা পুষে আমাদের বাড়ি আর দাদুদের বাড়ির মধ্যে খবর দেওয়া-নেওয়া করি। ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি পায়রা, দিব্যি পকেটে পুরে রাখা যায়। একটা পায়রা ছোটোমামাকে এনে দিয়েছি। সেটার কথাই বলছেন।
ছোটো মাস্টার এমন কথা কখনো শোনেননি। বললেন, উনি থাকেন কোথায়?
গুপি আমার দিকে চেয়ে একটু মাথা নাড়ল। ছোটো মাস্টার লজ্জা পেয়ে বললেন, জানি অবিশ্যি আপাতত ছাপাখানায় চাকরি নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন। ভালো খানদান, কিন্তু সবসময় এত ঘোরাঘুরি করেন যে গায়ে মাংস লাগে না। শুনেছি এক তলা থেকে পাঁচ তলা অবধি দিনের মধ্যে পঁচিশ বার ওঠা-নামা করেন। বড়ো স্যার বারি চটা ওঁর উপর। তবে উনিই যে গুপির ফেরারি ছোটোমামা এটা জানা ছিল না। সাহসী বটে।
ছোটো মাস্টার উঠে দাঁড়াতেই, গুপি ব্যস্ত হয়ে বলল, বড়ো মাস্টারকে ছোটোমামার কথাটা বলবেন না কিন্তু স্যার, তাহলে সব ভেস্তে যাবে। শেষটা হয়তো আমাদেরও চাদে যাওয়া হবে না!