আমি বললাম, তা হলে কী করা উচিত?
গুপি বলল, এখন মোটে সাতটা। আটটা অবধি বসি। ছোটোমামা ঠিক সাঁতরে ফিরে আসবে। দারুণ সাঁতার কাটে জানিসই তো। সেবার সেই যে সোনার মেডেল পেল। বেড়ালরা কিছু জলে নেমে ওর পেছন পেছন সাঁতার দেবে না।
সঙ্গেসঙ্গে চুপ্পড় ভিজে ছোটোমামার প্রবেশ। দাড়িগুলো ভিজে গালের সঙ্গে লেপটে রয়েছে।
আমাকে বললেন, পানু, প্যান্ট দে, গেঞ্জি দে, গামছা দে। আমার আলনাতেই সব ঝোলানো থাকে। পাশেই স্নানের ঘর। দশ মিনিটের মধ্যে গা মুছে, কাপড় বদলে ছোটোমামা চেয়ারে বসে
ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। নাকি গলায় দাড়ি জড়িয়ে গিয়ে সাঁতারের খুব কষ্ট হয়েছে। তা ছাড়া ইলিশ মাছে পায়ের আঙুলে ঠুকরে দিয়েছে। আইডিন দেওয়া দরকার। তাই দেওয়া হল।
রামকানাই একবার উঁকি মেরে বলল, ওই আরেক খদ্দের এলেন।
আমি বললাম, গরম চা জলখাবার কী আছে এনে দাও।
রামকানাই গরম চা আর ডিম দিয়ে পাঁউরুটি ভেজে এনে বলল, থাকে কখনো ঘরে কিছু? এয়ারা যা সব রাকস।
ছোটোমামার খাওয়া শেষ হওয়া অবধি আমরা চুপ করে ছিলাম।
তারপর হাত ধুয়েই বড়ো বড়ো চোখ করে বললেন, বুড়ো চিনেছে নাকি আমাকে? তা হলেই তো বাবার কাছে লাগাবে, অমনি সামন্তর পেয়াদারা এসে ধরে নিয়ে যাবে। তাহলে রহস্য উদঘাটন কে করবে?
এই সময় ছোটো মাস্টার টুক করে ঘরে ঢুকে একটা মোড়ায় বসে লজ্জিতভাবে বললেন, চুল কাটাচ্ছিলাম পাড়ার সেলুনে। সেখানে বেড়ালের কথা শুনে ছুটে এলাম। ভাবলাম তাহলে হয়তো নেপোকে পাওয়া গেছে। কিন্তু তোমাদের মুখ দেখেই ভুল ভেঙেছে, আর বলতে হবে না।
ঠক ঠক ঠক ধড়াস্।
ছোটোমাস্টার চমকে উঠলেন। দিনরাত ঠান্ডাঘরে কাজ হয়, তবুবাড়ি তৈরি শেষ হয় না কেন?
ছোটোমামা আঙুল দিয়ে দাড়ি শুকোতে শুকোতে বললেন, অন্য কাজ হয়। বাড়ি তৈরির কাজ নয়। ঠান্ডাঘর যদি হবে তো তার বিজলির ব্যবস্থা কই? সুযোগ পেলেই ছোঁকছোঁক করে বেড়াই। এটুকু বুঝেছি যে ওখানে ঠান্ডা করার কোনো ব্যবস্থাই হয় না।
আমরা বললাম, তবে কি স্পেসশিপের কথাই ঠিক? ঠান্ডাঘরটা ছদ্মবেশ?
ছোটো মাস্টার বললেন, তা স্পেসশিপ বানাবে, তারজন্যে অত গোপনীয়তার কী আছে? আমাদের দেশের লোকে মহাকাশযান তৈরি করছে, এ তো ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াবার কথা। লুকিয়ে করবে কেন?
ছোটোমামা বললেন, প্রকাশ্যে করলেই হয়েছে! অমনি প্ল্যান চুরি যাবে, পার্টস্ চুরি যাবে, সরকারি তলব আসবে, স্পেসশিপ বানাচ্ছ তার পারমিট কোথায়, ছবি-সহ দরখাস্ত করো। আমি জানি না? ফালতু জিনিস দিয়ে ঘরে বসে রেডিয়ো বানিয়েই আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে! করতে হলে লুকিয়েই করতে হবে। আপনি যেন আবার এসব কথা ফাঁস করে দেবেন না।
ছোটো মাস্টার জিব কেটে বললেন, না, না, কী যে বলেন! কিন্তু হাজার হাজার বেড়াল এল। কোত্থেকে! স্পেসশিপ করতে কি বেড়াল লাগে? মানে লোম-টোমে ইলেকট্রিসিটি–
নেপোর জন্য বড় ভাবনা হল।
গুপি বলল, তাও বুঝলেন না? একেবারে ঝপ করে তো আর চাঁদে মানুষ পাঠানো যায় না। প্রথমে এদের পাঠানো হবে।
কিন্তু এতগুলো কেন? দুটো-একটা পাঠালেই তো হয়। তাই তো সব দেশ থেকেই পাঠায়। গুপি বলল, মানুষের ওজন সইবে কিনা সেটাও তো দেখা দরকার। একটা আড়াইমনি মানুষের সমান ওজন নিতে হলে, ক-টি দেড়-সেরি বেড়াল লাগবে বলুন তো? একেবারে এক-শো দেড়-শো মানুষ নিরাপদে যাওয়া-আসা করতে পারবে কি না, তাও তো দেখা দরকার।
ছোটো মাস্টার তখন জানতে চাইলেন, কোথায় রাখা হয়েছিল এত বেড়াল? আমরা ছোটোমামার দিকে চাইলাম।
গুপি বলল, ছোটো করে বল, ছোটোমামা!
ছোটোমামা বললেন, আজ অনেকদিন যাবৎ এই গুরু তদন্তের দায়িত্ব একলা
গুপি বলল, ছোটোমামা, ফের!
ছোটোমামা বললেন, ওই নকল ঠান্ডাঘরের ওদিকের দেয়ালে, ঠিক গঙ্গার উপরেই দেখলাম একটা বড়ো চোঙার মুখ। কাঠ দিয়ে এঁটে বন্ধ করা। সামান্য কাঠে আমি ভড়কাই না। দুটো মাছওয়ালা রোজ গলি দিয়ে যায়, তাদের কিছু পয়সা দিয়ে রাজি করিয়ে, হাতুড়ি দিয়ে কাঠটি ভাঙালাম। কাঠ ভেঙে যেই না ওরা মাছের চুবড়ি মাথায় তুলেছে, অমনি চোঙার মধ্যে থেকে সে কী খচমচা খামচি!
০৯.
ছোটোমামা বলতে লাগলেন, সে যে কীসের খ্যাঁচম্যাচ সেটা বুঝতে আর বেশি দেরি লাগল না। ঝরনার মতো ঝুপ ঝাঁপ ধুপ ধাপ করে কেবলই বেড়াল পড়তে লাগল। মাছওয়ালারা একবার তাকিয়েই চুবড়ি তুলে দে দৌড়। আর যাবে কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালের নদীও ছুটল! আমিও কি আর সেখানে থাকি! পাইপই লাগালাম। মাছের গন্ধেই বেড়াল বেরিয়েছে। আমি ছোটোবেলা থেকে কড লিভার অয়েল খেয়ে মানুষ, আমাতে আর মাছেতে কতটুকু তফাত তোরাই বল্। ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে কোনোমতে একটা নৌকাতে যদি-বা উঠলাম, সঙ্গেসঙ্গে এই কেঁদে কেঁদো গোটা পঁচিশ বেড়াল। জলে নেমে সাঁতরে কোনোরকমে প্রাণটা হাতে করে ফিরেছি। পানু, আরও পান দে। আর সেই খোঁচা গোঁপ ভদ্রলোক কোথায় উঠে গেলেন? কে উনি?
তাকিয়ে দেখি, তাই তো ছোটো মাস্টার কখন হাওয়া হয়ে গেছেন। গুপি বলল, ওর নাম তলাপাত্র, এম.এ পাস, বড়ো মাস্টারের শাকরেদ।
ছোটোমামা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! তবে তো নির্ঘাত ওঁর স্পাই! আর আমি কিনা ওঁর সামনে সব কথা ফাঁস করে দিয়েছি! ই–ই– স্!