তারপর বললেন, বোধ হয় আমার ওই নৌকোর মাঝি সাহেবদের গুপ্তচর ছিল। আমাকে নামিয়েই শহরে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল। এইরকম করেই সাহেবদের অত টাকা হয়েছিল।
নইলে এমনি সময় আমাদের গলিতে সে কী দুপদাপ কাঁও ম্যাও! জানলা দিয়ে দেখি স্রোতের মতো বেড়ালের পাল ছুটে বেরিয়ে আসছে। বড়ো মাস্টার লাফিয়ে উঠে খটখট করতে করতে দৌড় দিলেন। দেখলাম তাঁর মুখটা অস্বাভাবিক রকমের সাদা। সঙ্গে সঙ্গে গুপিও ছুটল।
০৮.
আমি তো হাঁ করে বসেই রইলাম। রামকানাই এসে খাবারদাবারগুলো তুলে নেবার তালে ছিল। বারণ করলাম। বললাম, থাক, ওদের পুষ্টিকর খাবার দরকার হতে পারে। অস্বাভাবিকরকম দৌড়োচ্ছে। রামকানাই ফোঁস শব্দ করে চলে গেল। আরও অনেকক্ষণ পরে গুপি ফিরে এসে কোনো কথা না বলে খেতে আরম্ভ করে দিল।
তারপর খানিকটা জল খেয়ে বলল, উঃফ, ভাবা যায় না।
আমি বললাম, নেপোকে দেখলে?
গুপি মাথা নাড়ল। কই, না তো। তবে ওই শত শত বেড়ালের মধ্যে চোখে নাও পড়তে পারে।
আমি চটে গেলাম। নেপোকে চোখে নাও পড়তে পারে মানে? সাধারণ বেড়ালের দেড়া সাইজ ওর, গোপগুলো পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, বেঁড়ে ল্যাজ। চোখে পড়তে বাধ্য।
গুপি বলল, তবে ছিল না।
এমনসময় বড়ো মাস্টারও হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলেন। ময়লা রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, সারাজীবন ধরে কোথায় না গেলাম, কী না দেখলাম। কিন্তু এর সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। দশ ফুট চওড়া বেড়ালের নদীর কথা কেউ কখনো শুনেছে? তার উপর বেড়ালের ঢেউ।
আমি তো অবাক! বেড়ালের ঢেউ আবার কী?
গুপি বলল, তাও বুঝলি না? পেছনের বেড়াল যদি বেশি জোরে দৌড়ায়, তাহলে সামনের বেড়ালের পিঠের উপর উঠে পড়বে। অমনি সেখানে ঢেউ উঠবে।
বড়ো মাস্টার চেয়ারে বসে কেবলই মাথা নাড়তে লাগলেন। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, বলুন-না গঙ্গার ধারে কী হল?
গুপি আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলল, বেড়ালের নদীর মাথায় তিনটে লোক দৌড়োচ্ছিল। তাদের চুল খাড়া, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। বেড়ালরা একবার ধরে ফেললেই তো হয়ে গেল।
বড়ো মাস্টার বললেন, দু-জনের মাথায় দুটো মাছের চুপড়ি, এক জনের মুখে দাড়ি। প্রাণের ভয়ে চুপড়ি ফেলে প্রথম দু-জন দে দৌড়। বেড়ালের স্রোত এতটুকু থামল না।
গুপি বলল, সামনের বেড়ালরা হয়তো থেমেছিল, কিন্তু তাদের মাথার উপর দিয়ে পেছনের বেড়ালরা সমান বেগে ছুটে চলাতে কিছু টের পাওয়া গেল না। ফেরার সময় দেখলাম চুপড়িগুলোর দুটো-একটা বাঁশের কুচি পড়ে আছে। আর কিছু নেই।
আমি উত্তেজনার চোটে চেয়ার থেকে ছয়-সাত ইঞ্চি উঠেই পড়েছিলাম। আর বেড়ালরা? নেপোকে তো খোঁজা দরকার।
মাস্টারমশাই বললেন, তাকে আর পেয়েছ! নদীর ধারে পৌঁছে লোক তিনটে আর কোনো উপায় না দেখে, ঝপাঝপ দুটো খালি যাত্রীর নৌকোয় লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে রাশি রাশি বেড়াল। তাই দেখে ঘাবড়ে গিয়ে যেখানে যত মাঝি ছিল যে-যার নৌকো নিয়ে পাড়ি দিল। আর বেড়ালরাও ঝুপ ঝাঁপ করে সেসব নৌকোয় চেপে বসল। পাঁচ মিনিটে গঙ্গার ধার ভেঁ ভা। শুধু যারা হাওয়া খেতে গেছিল তারা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল আর দূর থেকে কানে এল একটা ম্যাও-ম্যাও শব্দ। এ-রকম যে সত্যি হতে পারে কে ভেবেছিল। আমিও না। অথচ একদিন এই আমি ব্রেজিলের সত্যিকার কাকড়ামতী নদী থেকে, প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে এসেছিলাম। সে এক
আমি চেঁচিয়ে বললাম, না, না, শুনব না। এত বেড়ালের মধ্যে নিশ্চয়ই নেপো ছিল। কেন তাকে ধরে আনলেন না?
খুব কান্না পাচ্ছিল। তার মধ্যে গুপি কর্কশ গলায় বলল, যদি থেকেও থাকে, তার বাড়ি ফেরার কোনো মতলব নেই।
মাস্টারমশাইয়ের কী যেন মনে পড়াতে উঠে বললেন, যাই, আমার কাজ আছে। দ্যাখ, পানু, আমাদের বড়ো সাহেব তোর জন্যে সায়ামিজ ক্যাটের বাচ্চা দেবে বলেছে। তোর বেড়াল হারানোর দুঃখের কথা শুনে তার বড়ো কষ্ট হয়েছে! আচ্ছা চলি।
বড়ো মাস্টার চলে গেলে গুপি আমার কাছে চেয়ার টেনে বসে বলল, ব্যাপারটা কিন্তু খুব ঘোরালো। যতদূর দেখলাম বেড়ালগুলো বেজায় মোটা। আর প্রত্যেকের গলায় ছোট্ট একটা করে সাদা টিকিট বাঁধা। সাধারণ বেড়াল নয় ওরা।
আমি নাক টানতে লাগলাম। কান্না পেলে আমার সর্দি লাগে। গুপি আবার বলল, বেড়াল তাড়া করা দাড়িওয়ালা লোকটা ছোটোমামা।
এমনি চমকে গেলাম, যে সত্যি সত্যি চেয়ায়-গাড়ি থেকে পড়ে গেলাম। রামকানাই ছুটে এল। দুজনে মিলে আমাকে টেনে তুলল। পায়ের গোড়ালিতে খুব ব্যথা লাগল। কানে এল ঠান্ডাঘর থেকে ঠক ঠক ঠক–।
গুপি বলল, শুনতে পাচ্ছিস না? স্পেসশিপ তৈরি হচ্ছে। তবু ব্যাপারটা বুঝতে পাচ্ছিস না? ওই বেড়ালরা কে তা টের পাচ্ছিস না?
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
গুপি বলল, ওরাই হল প্রথম ভারতীয় চন্দ্রযাত্রী। ট্রেনিং নিচ্ছে। আমি তখুনি সব বুঝতে পেরেছি কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের সামনে কিছু বলিনি। ভারতীয় মানুষ যাবার আগে ওরাইচঁদে যাবে। নেমে যদি আমাদের আগে চাঁদে যায়, তাতে তোর গর্ব হওয়া উচিত, নাক টানা উচিত নয়। ভেবে দ্যাখ, আমরা পৌঁছোলে তার কী আনন্দটাই হবে।
আমি বললাম, কিন্তু পালিয়ে গেছে যে। চাঁদে যাবে কী করে?
গুপি বলল, মোটই পালায়নি। যাদের নেয়নি, তারাই পালিয়েছে। হয়তো গলার টিকিটে লেখাই ছিল, অমনোনীত, পড়তে তো আর পারিনি।