আস্তে আস্তে ডুব দিলাম। একেবারে সমুদ্রের তলাকার বালির উপর নামলাম। বুঝতেই পারছিস সমুদ্র সেখানে বেশি গভীর নয়, বিশেষ করে এই গরমের সময়ে। গভীর না হলেও অদ্ভুত। কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু সবুজ আলোতে সব দেখতে পাচ্ছিলাম। অদ্ভুত আকারের মাছ, সমুদ্রের কচ্ছপ আর কতরকম পলা আর আগাছা।
তলাপাত্র তোদের যে এতরকম জ্ঞান দেয়, আশা করি একথা বলতে ভোলেনি যে পৃথিবীর তিন ভাগ যখন জল আর মাত্র এক ভাগ মাটি, তখন মাটিতে যত-না ফসল হয়, জলে হতে পারে তার তিন গুণ। দেখলাম সেসব ফসলের কিছু কিছু একেবারে গিজগিজ করছে, শুড় নাড়ছে, দাঁত দেখাচ্ছে, চোখ পাকাচ্ছে। ডাঙায় তুলে বেঁধে খেলেই হল। হাজার বছরের খাদ্য মজুত আছে সমুদ্রের নীচে!চাদে জমি কেনার কথা বলিস তোরা, সমুদ্রের তলাকার জমি কিনতে পারলে আর কথা নেই।
এক জায়গায় দেখলাম একেবারে জ্যান্ত ঝিনুক ছেয়ে আছে। প্রত্যেকটির মধ্যে একটি করে বড় মুক্তো না থাকে তো কী বলেছি!
গুপি বলল, তুললেন না কেন দু-চারটে?
বড়ো মাস্টার ভুরু কুঁচকে বললেন, সামান্য মুক্তো তুলে সময় নষ্ট করব নাকি? আমার সামনে ছিল তার চেয়ে অনেক বড়ো উদ্দেশ্য। যার জন্যে এই অভিযান। তা ছাড়া দুটো চারটে যে তুলিনি তাই-বা কী করে জানিস! দেখিস গিয়ে তোদের বউঠানের কানে। চোখ টেরা হয়ে যাবে।
বড়ো মাস্টার পানের ডিবে খুলে রামকানাইয়ের দিকে তাকালেন। রামকানাই রেডি ছিল। পকেট থেকে ভিজে ন্যাকড়ায়-জড়ানো গোটা ছয় বড়ো পান বের করে ডিবে ভরে দিল। আজকাল দেখছি পারলে রামকানাই বড়ো মাস্টারের গল্প শুনতে ছাড়ে না। পরে অবিশ্যি নানারকম মন্তব্য করে। ভারি ইয়ে হয়েছে ওর। যাই হোক, মুখে দুটো পান পুরে, দাঁতে চুনের টিপ মুছে, মাস্টারমশাই বলতে লাগলেন।
–একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপরে না উঠলে অক্সিজেনের থলি খালি হবার ভয় থাকে। তাতে অবিশ্যি ডাঙায় ফেরার অসুবিধে হয় না। উপরে উঠে সাঁতরে ফিরলেই হল। কিন্তু তদন্ত করতে হলে, তাড়াতাড়ি কাজ করলে হয় কখনো?
আর একাজ সারতে হবে খুব গোপনে। কেউ টের পেলেই হয়ে গেল। হাঁসের সাজ পরে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়বে! পাকা খবর না নিয়ে যাইনি। খুব গূঢ় খবর। ওইখানে একটা পুরোনো পোতুর্গিজ জলদস্যুদের সমুদ্রের জাহাজ বমাল সমেত ডুবে পড়ে আছে। তিন-শো বছরের বেশি হয়ে গেছে।
বর্মায় থাকতেই একজন নাবিক আমার বাবার কাছে একটা চিঠি আর এক সমুদ্রের তলার ভেঁড়া ম্যাপ এক টাকা দিয়ে বিক্রি করেছিল।
গুপি অবাক হয়ে গিয়ে বলল, মোটে এক টাকা দিয়ে?
বড়ো মাস্টার বললেন, কেন, এক টাকা কি কম নাকি? আমার ঠাকুরদার বাবা এক টাকা দিয়ে এক-শো মন ধান কিনতেন। এক টাকা রোজগার করতে পারিস? গল্প শুনবি, না কি?
গুপি বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপর?
–তারপর হঠাৎ পায়ে কী একটা ফুটল। তুলে দেখি একটি মোহর, খাড়া হয়ে বালিতে বিধে আছে। চেয়ে দেখি চারদিকে বালিতে ছড়ানো হাজার হাজার মোহর। সামনে একটা পুরোনো লোহার সিন্দুক ভেঙে পড়ে আছে। জং ধরে সবুজ হয়ে গেছে। তার গায়ে কত খুদে খুদে সামুদ্রিক প্রাণী বাসা বেঁধেছে।
চোখ তুলে দেখি আরেকটু দূরে মস্ত মরা তিমি মাছের মতো একটা পুরোনো জাহাজ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। খোলটা উপর দিকে, তাতে অসংখ্য ছোটো-বড়ো ছাদা। তার ভিতর দিয়ে শত শত ছোটো, বড়ো, লাল, কালো, হলদে মাছ আসছে, যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে আর কূল পাই না। তবে বেশিক্ষণ চাইতে হল না। চারদিক থেকে নিঃশব্দে পনেরো-কুড়িটা ছায়া নেমে এল। দেখলাম পনেরো-কুড়িটা সাহেব। সকলের হাঁসের সাজ, সঙ্গে শুধু হান নয়, বন্দুকও। প্ল্যাস্টিকের থলিতে ভরা, যাতে ভিজে না যায়।
তারপর আর কী, দেখতে দেখতে আমাকে ধরে ফেলে তারা ভাঙা নৌকোর কানা তুলে তার ভিতরে পুরে দিল। বলিনি এই ঘটনার বিষয়বস্তু হল বুড়ো ধরা? এবং সত্যিই আমিই সেই হতভাগ্য বুড়ো। তারপর যত পারল সোনাদানা চেঁচেপুঁছে নিয়ে চলে গেল।
আমি প্রথমটা জাহাজের খোলের ভিতরকার গাঢ় অন্ধকার দেখে, হকচকিয়ে গেলাম। তারপর আস্তে আস্তে যখন চোখ সয়ে গেল, তখন চেয়ে দেখলাম কত কঙ্কাল চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তা ছাড়া কত যে গয়নাগাটি ছড়ানো, সে আর কী বলব।
গুপি বলল, আনলেন না স্যার, তাহলে এখন কত সুবিধে হত! স্পেসশিপের অনেক খরচ।
বড়ো মাস্টার বললেন, তখন আমি বেরুবার পথ খুঁজতে ব্যস্ত, গয়না তোলার কথা মনেও হয়নি। তা ছাড়া কঙ্কালগুলো জলের মধ্যে কেমন নড়ছিল চড়ছিল। শেষপর্যন্ত হাৰ্পন দিয়ে একটা ছাদাকে আরেকটু বড়ো করে নিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম। এদিকে অক্সিজেন প্রায় শেষ, কোনো মতে জলের উপরে উঠলাম। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। কোনোরকমে সাঁতরে ডাঙায় উঠলাম। তারপর বাদাম গাছের নীচে গিয়ে দেখি সর্বনাশ, বাঁদররা সব জিনিসপত্র তছনছ করে, চারদিকে ছড়িয়েছে। অন্য জিনিস প্রায় সবই পেলাম। শুধু সেই চিঠিটা আরম্যাপটা ছাড়া মাঝে মাঝে কাগজে যখনই দেখি ডুবো জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেছে ভারতের উপকূলের কাছে, ভাবি এই আমার সেই জাহাজ।
গুপি বলল, তবে জাহাজটা তো আর সত্যি করে আপনার নয়। অন্যরাই-বা নেবে না কেন?
বড়ো মাস্টার বললেন, আমার নয় মানে? দস্তুরমতো এক টাকা দিয়ে ওর কাগজপত্র কেনা হয়নি বলতে চাস?