বড়ো মাস্টার চোখ থেকে চশমা জোড়া খুলে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন! তারপর বললেন, বুড়োধরার কথা বলেছিলাম কি?
০৭.
আমি বললাম, বুড়োধরা আবার কী? সেরকম আছে বলে তো শুনিনি।
বড়ো মাস্টার বললেন, তা যদি না থাকত তো এতদিনে এই পৃথিবী বুড়োতে ছেয়ে যেত। তোদের আর দাঁড়াবার জায়গা থাকত না।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আপনাকে ধরেছিল বুঝি?
বড়ো মাস্টার রেগে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, আমাকে আবার বুড়ো দেখলি কোথায়? বুড়োরা দিনের মধ্যে দশ বার কেঠো পা নিয়ে পাঁচ তলা অবধি ওঠা-নামা করতে পারে?
হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেললাম, গুপির ছোটোমামা বলেন আপনি ছাপাখানার লিফটে চড়ে চার তলায় ওঠেন, তারপর সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলায় ওঠেন। সেটুকু সব বুড়োরাই পারে।
মাস্টারমশায়ের মুখটা প্রথমে লাল হয়ে তারপর বেগনি হয়ে গেল। আমি তো ভয়েই মরি, এক্ষুনি-না ফেটে যান।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে মাস্টারমশাই বললেন, গুপির ছোটোমামা মানে সেই কুখ্যাত ফেরারি আসামি চাঁদু তো? সে আমাকে কোথায় দেখল?
আমি তো মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। এর আগেই গুপি আমাকে বলেছিল যে ছোটোমামার প্রাণ আমার হাতে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ওঁর ভালো নাম নৃপেন্দ্রনারায়ণ।
–তা হতে পারে, কিন্তু সে আমাকে দেখল কোথায়? এই বলে বড়ো মাস্টার আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন।
আমি বললাম, না, তা নয়, দেখেননি হয়তো। কিন্তু উনি বলেছিলেন যে সরকারি ছাপাখানার লিট তো চার তলায় শেষ। তারপর বোধ হয় তোদের মাস্টারমশাইকে হাঁটতে হয়।
–কাকে বলছিলেন? তোকে?
না, না, আমাকে তো ভলো করে চেনেন না, তাই গুপিকেই বলেছিলেন। গল্পটা বলবেন না? বড়ো মাস্টার ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ওঃ, আমার জন্যে ভেবে ভেবেচঁদুর বুঝি ঘুম হয় না? গুপিকে বলিস ওকে বলে দিতে ও কী! অমন চমকে উঠলি কেন?
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝেছি। বলবে কী করে? সে এতক্ষণে জলঢাকায় কি সোফিয়ায় কি নাথুলায় কি কোথায় তাই-বা কে জানে!
আমি বললাম, তা ছাড়া গুপির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে, সে এখন আমাদের বাড়িতে আসবে না।
সঙ্গেসঙ্গে গুপি ঘরে ঢুকে বলল, না স্যার, ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না, স্যার। ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলে আসব নাই-বা কেন, আপনার গল্প শুনব নাই-বা কেন, খাব নাই-বা কেন?
এই বলে রামকানাইয়ের হাত থেকে ছোটো ছোটো মাংসের বড়া আর আলুমটর সিদ্ধর থালাটা নামিয়ে নিয়ে, তিনটে প্লেটে ভাগ করতে লাগল। মাস্টারমশাই এক বার ওর দিকে, এক বার আমার দিকে তাকাতে তাকাতে চামচ দিয়ে খেতে লাগলেন। তখন গুপি পকেট থেকে দুটো মলাট-আলগা বই বের করে বলল, তা ছাড়া, ওর এসব পড়া দরকার। নইলে চাঁদে যাবার মতো যথেষ্ট জ্ঞান হবে কী করে?
চোখ বুলিয়ে দেখলাম। একটার নাম, চাঁদ উপনিবেশ অন্যটার নাম, চাঁদের আবহাওয়া। ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে কথা বলে কাজ নেই। বই দেখে বললাম, কোথায় পেলি রে?
গুপি বলল, ছোটো স্যারের কাছ থেকে নিয়েছিলাম।
মাস্টারমশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমাদের মাথা খেতে আর বড়ো বেশি বাকি রাখেনি তলাপাত্র। ওটা কীসের মডেল?
আমি খুব খুশি হলাম। বললাম, ওটা স্পেসশিপের পার্ট। ওর ভিতরে মানুষরা বসে থাকবে, মহাকাশযান পাক খেলেও মানুষগুলো স্থির হয়ে বসে থাকবে।
বড়ো মাস্টার একটুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, পুনালুর গেছিস কখনো?
আমরা তো অবাক।
পুনালুর আবার কোথায়? কোনো গ্রহের উপগ্রহ-ট্রহ নয় তো?
মাস্টারমশাই হেসে বললেন, ওই যা বলি, চাঁদ চাঁদ করে তোরা খেপে গেলি, অথচ এই পৃথিবীটার কিছুই দেখলি না। পুনালুর শুধু এই পৃথিবীতে নয়, আমাদের নিজেদের দেশে। মাদ্রাজ থেকে ত্রিবান্দ্রাম যেতে হলে প্রায় একটা গোটা দিন লেগে যায়। পথে খাওয়ার খুব ভালো ব্যবস্থা না থাকলেও, যেইনা পশ্চিমঘাট ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আমাদের ট্রেন পুনালুরে থামল, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা স্টেশন, তারপরেই সমুদ্রের গন্ধ পেলাম। তারপরেই কুইলন বলে একটা জায়গায় নেমে পড়লাম। সঙ্গে সামান্য জিনিসপত্র। কিছু কাপড়-চোপড়, একটা শতরঞ্চি আর হাঁসের সাজ!
আমি বললাম, হাঁসের সাজ আবার কী মাস্টারমশাই?
বড়ো মাস্টার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হাঁসের সাজ কী তাও জানিস না? এই বিদ্যে নিয়ে চাদে যেতে চাস? হাঁসের সাজ না পরলে সমুদ্রের তলায় সরেজমিন তদন্ত করব কী করে শুনি? কেঠো পায়ের উপর আড়াইমনি ডুবুরির পোশাক চাপালেই হয়েছে আর কী!
গুপি গলা খাঁকরে বলল, অবিশ্যি জলের নীচে আড়াই মন আর কিছু আড়াই মন থাকে না! বয়েন্সি অর্থাৎ প্লবতা জলের একটা গুণ!
বড়ো মাস্টার বিরক্ত হয়ে বললেন, থাক, আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না। এও নিশ্চয় তলাপত্রর কাছে শেখা? বেশ, আড়াই মন নাহয় দেড় মনই হয়ে যাবে, তবুও আমার শরীরের আড়াই মন তার সঙ্গে জুড়তে হবে। কাঠের ঠ্যাং হয়তো ত্রিশ বছর সেই জাহাজের রান্নাঘরের টেবিল ঠেকিয়েছে। তারপর আমার কাছেই আছে ধর এই পঁয়ত্রিশ বছর। আর কত সইবে?
গুপি বলল, আচ্ছা, এবার বলুন হাঁসের সাজের কথা।
বড়ো মাস্টার বললেন, আর কিছুনয়, দু-পায়ে প্লাস্টিকের তৈরি বড়ো বড়ো হাঁসের পা লাগিয়ে, মুখে মুখোশ, চোখে বড়ো বড়ো গগলস্ এঁটে, পিঠে অক্সিজেনের থলি বেঁধে, মুখোশের ভিতরে নাকে তার নল গুঁজে, হাতে হাপুন নিয়ে তৈরি হয়ে নিতে কতক্ষণ লাগে! অতিরিক্ত বেশি পয়সাকড়ির বালাই নেই, সঙ্গে রিটার্ন টিকিট আর যৎসামান্য খাইখরচা। তা ছাড়া ছোট্ট বিছানা আর কাপড়-চোপড়। বাদাম গাছের মগডালে সেগুলো ঝুলিয়ে রেখে, কুইলনের সমুদ্রের ধারে গিয়ে জেলেদের একটা নৌকো ভাড়া করলাম। তীর থেকে সিকি মাইলটাক গিয়ে নৌকোতে বসে বসেই যেই না হাঁসের সাজ পরেছি, ভয়ের চোটে নৌকোর মাঝি মাঝদরিয়ায় নৌকো থেকে নেমে যায় আর কী! অনেক করে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নৌকো থেকে টুপ করে জলে নেমে পড়লাম। নেমেই টের পেলাম ব্যাটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ডাঙার দিকে পাড়ি দিল। যাক গে, এসব সামান্য জিনিসে আমি ভয় খাইনা। মিছিমিছি তো আর বর্মার শ্রেষ্ঠ সাঁতারুর সম্মান পাইনি। মানপত্র, সুবর্ণ পদক, টাকার থলি– যাক গে, নিজের বিষয়ে বেশি বলা আমি পছন্দ করি না।