আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, মানা কর, গুপি, বাড়িতে পা দিয়েছে কি কাঁক করে সামন্ত ওকে ধরবে। ওর ঘরে-না চোরাই গাড়ির নম্বরপ্লেট পাওয়া গেছে।
গুপি বলল, আরে দূর! দূর! সে-বিষয়ে ছোটোমামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল নাকি বড়ো রাস্তার ওদিকে পুরোনো লোহার উঁই আছে, সেখান থেকে কুড়িয়ে এনেছে। গাড়ির নম্বরপ্লেট খুলবে ও! আমাকে দিয়ে নিজের পেনসিল কাটায়, ব্লেড দেখলে ওর গা শিরশির করে! নেংটি ইঁদুর ভয় পায়।
তারপর হঠাৎ থেমে গুপি বলল, ছোটো মাস্টারকে কি চোরাই কারবারি মনে হয়?
ভয়ানক রাগ হল। বললাম, আমাদের বাড়িতে যারা আসে যায়, তাদের তোর সন্দেহবাতিক। থেকে বাদ দে। সামন্তর তো ধারণা যে তোর ছোটোমামাই চোরাই কারবারের চাঁই।
গুপি তার জিনিসপত্র গুটিয়ে তুলে চলে গেল। দরজার কাছ থেকে বলে গেল, আশা করি এর পরেও ছোটোমামার স্পেসশিপে জায়গা আশা কর না।
আমিও চটেমটে বললাম, যারা স্পেসশিপ বানায়, তারা পুরোনো লোহার ছ্যাকড়া ঘুড়ি চড়ে না।
গুপি চলে গেলে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের সব খবর ওর কাছেই পাই। বলতে গেলে ও-ই আমার একমাত্র বন্ধু। ছোটো মাস্টারের হাতে-লেখা চাঁদ বিষয়ক নোট বইটা খুলে বসলাম। তাতে এই সব লেখা:
(১) চাঁদ পৃথিবী থেকে গড়পড়তা দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরে।
(২) তার মধ্যে দুই লক্ষ যোলো হাজার মাইল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির এলাকার মধ্যে। বাকি চব্বিশ হাজার মাইল চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের এলাকায়।
(৩) চাঁদে নামতে হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে সেখানে বাতাস নেই। শব্দতরঙ্গ ওঠে না, অর্থাৎ কানে কিছু শোনা যায় না। নিশ্বাস নেবার অক্সিজেন নেই, কাজেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। বায়ু নেই বলে সূর্যের আলোর বেজায় তাপ। আর রাতে বেজায় ঠান্ডা।
(৪) চাঁদের একেকটা দিন আর রাত আমাদের চোদ্দো দিনের সমান লম্বা। এক দিন আর এক রাতেই চাঁদের এক মাস কাবার হয়।
(৫) চাঁদ সর্বদা পৃথিবীর দিকে তার একটা পিঠই ফিরিয়ে রাখে। পৃথিবী থেকে অন্য পিঠটা দেখা যায় না, তবে রকেট থেকে তার ছবি তুলে দেখা গেছে যে সে-দিকে পাহাড়-পর্বত কম। নামতে হলে ওদিকেই সুবিধা।
(৬) প্রথম বৈজ্ঞানিকরা চাঁদে গিয়ে, মাটির নীচে উপনিবেশ তৈরি করবে। তাহলে রাতের বড় বেশি ঠান্ডা আর দিনের বড়ো বেশি গরম থেকে বাঁচা যাবে। উপনিবেশটা হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত।
(৭) নিশ্বাস নেবার অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে আর নিশ্বাস ফেলার সঙ্গে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেরুবে তাকে দূর করতে, ক্লরেলা বলে একরকম শ্যাওলার চাষ করা হবে, মাটির নীচের সেই উপনিবেশে ক্লরেলার অন্য নাম ডাকউইড।
এইসব পড়ে আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাহলে আমাদের বাতাসের ব্যাবসাটা তুলে দিতে হয়। তা হোক। ক্লরেলার চাষ করব। তাহলে জমি কিনতে হবে মাটির নীচে।
ভেবে দেখলাম চাঁদের মাটির তলার উপনিবেশে কী কী লাগতে পারে। জোনাকি পোকা সরবরাহ করা যায়। লক্ষ লক্ষ জোনাকি ছাড়লে মাটির তলার গুহাঘর নিশ্চয় আলো হয়ে থাকবে। তবে হয়তো বিজলিবাতির ব্যবস্থা হবে। তাহলে জোনাকি লাগবে না। এক যদিনা বিজলি বাঁচাবার জন্যে স্নানের ঘরেটরে ব্যবহার করা যায়। জোনাকি দিয়ে বোধ হয় রান্নার উনুন জ্বালানো যাবে না। একবার ধরেছিলাম মুঠো করে পাঁচ সাতটা। একটুও গরম মনে হয়নি।
পরদিন রবিবার। যখন বড়ো মাস্টার এলেন, চাঁদের সম্বন্ধে না বলে পারলাম না। মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। বললেন, তার চেয়েও অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক কথা হল যে আমাদের এই ভারতের দক্ষিণ দিকের তীরভূমির কাছাকাছি সমুদ্রের তলা থেকে রাজার ঐশ্বর্য তোলা যায়।
আমি বললাম, মুক্তো?
বড়ো মাস্টার হাসতে লাগলেন, মুক্তো হবে কেন? মুক্তো আর এমন কী, আজকাল মুক্তোর চাষ হয়, মুক্তোর দিন গেছে।
–তবে?
বড়ো মাস্টার বললেন, জাহাজডুবির কথা শুনেছিস?
ইংরেজরা এদেশের নাম শোনার অনেক আগে পোর্তুগিজরা ব্যাবসা করতে আসত। আবার জলদস্যু বোম্বেটেরাও ছিল। সমুদ্রে লড়াই হত, ঝড় হত, ডুবন্ত পাহাড়ে জাহাজের তলা ফেঁসে যেত, জাহাজডুবি হত। তার অনেক জাহাজ এখনও সমুদ্রের তলায় পড়ে আছে। সোনারুপোর গয়না, হিরে মণি মাণিক, এত বড়ো বড়ো মোহর সমুদ্রের নীচেকার বালির উপর ছড়িয়ে পড়ে আছে। কত লোকে নিজের চোখে দেখে এসেছে। আমিও।
আমি অবাক হয়ে বড়ো মাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম। চেয়ারের হাতলে দু-হাত চাপড়ে কেঠো পা মাটিতে ঠুকে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও। এবং এই কাঠের পা নিয়েই, আমাকে কি ওই ফেরারি ছোটোমামাটির চেয়ে কম ঠাউরেছিস নাকি?
চমকে উঠেছিলাম। তবে কি গুপি ভুল বলল, ছোটোমামাকে বড়ো মাস্টারমশাই চিনে ফেলেছেন। তাহলে সামন্তের কানে কথাটা তুলতেই-বা কতক্ষণ!হয়ে গেল চাঁদে যাওয়া। সঙ্গেসঙ্গে মনে পড়ে গেল ছোটো মাস্টারের কথা। বড়ো মাস্টার বললেন, হাসছিস যে বড়ো? আমার কথাটা বিশ্বাস হল না বুঝি?
–না, না, সেজন্যে নয়, ডুবো জাহাজের কথা খুব বিশ্বাস করেছি। কিন্তু কাল টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলাম, জিনিসপত্রে বোঝাই আকাশি নৌকো চাদে যাচ্ছে।
–সে কী! চাঁদে জনমানুষ নেই, জিনিসপত্র যাচ্ছে আবার কী? কেনই-বা যাচ্ছে?
আমি বললাম, বাঃ, মাটির তলায় উপনিবেশ হবে যে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত উপনিবেশ তৈরি করতে হলে যন্ত্রপাতি, তার, তক্তা, স্ক্রু ইত্যাদি লাগবে না?