আমি বললাম, বাবা বলছিলেন, এর মধ্যে রাশিয়ানদের একটা জিন্ডপাঁচ চাঁদের চারদিকে ঘুরে ফিরে এসেছে। এর আগে চাঁদে রকেট নেমেছে বটে, কিন্তু এক বার নেমে, আবার উঠে ফিরে আসেনি। বোধ হয় মানুষ না গেলে, সেটা খুব শক্ত হবে। ইস, পা-দুটোর উপর এমনি রাগ হয়! এই বলে পা-দুটোকে শক্ত করবার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন ঝিঁঝি ধরার মতো মনে হল।
ঠিক সেই সময় একটা ছোটো বান্ডিল হাতে নিয়ে গুপি এসে উপস্থিত। স্কুলের জন্মদিন বলে সেদিন নাকি একটায় ছুটি হয়ে গেছে। পুঁটলিতে কী?
গুপি একটু লজ্জা পেল। খিদিরপুর ডকের কাছে নাকি সস্তায় খুব দরকারি সব পুরোনো জিনিস বিক্রি হচ্ছিল। তারই কিছু কিনে এনেছে। খুলে দেখলাম নাইলনের হাওয়া-বালিশ, হাওয়া না থাকলে রুমালের মতো ছোটো করে ভাজ করে ফেলা যায়। নাইলনের জলের বোতল আর খাবার রাখার থলি। হাঁ করে ছোটো মাস্টার গুপির দিকে চেয়ে রইলেন। গুপি বলল, হ্যাঁ স্যার, আগে থাকতেই বন্দোবস্ত করা ভালো। বেশিদিন তো আর নেই। নিজেদের খাবার-দাবার নিজেরা নিলেই ভালো। শুনলাম পাঁচ দিনের ওয়াস্তা; পাঁচ দিন! মানে, খালি রকেট সাত দিনে গিয়ে ফিরতে পারে বটে, কিন্তু লোকজন জিনিসপত্র থাকলে নিশ্চয় কিছু বেশি সময় লাগবে। হয়তো যেতে-আসতে পাঁচ-পাঁচ মোট দশ দিন।
আমি বললাম, চোঙা মতো ওটা কী? গুপি হেসে বলল, এটাই তো আসল জিনিস। চঁদ দেখার টেলিস্কোপ। কোনো জাহাজের খ্যাপা ক্যাপ্টেন নাকি ওটাকে বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়েছিল, আর ছাড়াতে আসেনি।
–টেলিস্কোপ? টেলিস্কোপ দিয়ে কী হবে?
ছোটো মাস্টার লাফিয়ে উঠলেন, আকাশ দেখার টেলিস্কোপ নাকি? সে তো অন্যরকম দেখতে হয়। তারপর টেলিস্কোপটা বের করে বললেন, না, আকাশ দেখার নয়। কিন্তু খুব পাওয়ারফুল। সমুদ্রে দূরে দেখার জন্য ব্যবহার হয়। আকাশে এরোপ্লেন ইত্যাদিও দেখা যায়। দেখবে নাকি, পানু?
ছোটো মাস্টার টেলিস্কোপের লেন্স পরিষ্কার করে দিয়ে, ফোকাস ঠিক করে, আমার হাতে দিলেন। আমি জানলা দিয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলাম। সব অন্যরকম লাগল। ঠান্ডা ঘরটাকে ভালো করে দেখলাম। মনে হল ছাদে কীসব পাইচারি করছে, ছোটোমতো, সাদা কালো। আলো কম বলে ভালো করে বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ একটা সন্দেহ হল, গুপি, নিশ্চয় পে– উঃ!
গুপি আমার হাঁটুর উপরে খুব জোরে চিমটি কাটল। আমি টেলিস্কোপ নামাতেই, ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে কিছু বলতে মানা করল। মুখে বলল, চাঁদ উঠেছে, দ্যাখ ভালো করে।
চাঁদের দিকে টেলিস্কোপ ফেরালাম। অদ্ভুত লাগল। অবিশ্যি পাহাড়-পর্বত এটা দিয়ে দেখা গেল না। কিন্তু আরেকটা জিনিস দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। স্পষ্ট দেখলাম, জিনিসপত্রে বোঝাই ডানাওয়ালা একটা নৌকোর মতো কী যেন, চাঁদের মুখের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে ভেসে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তার কুচকুচে কালো আকৃতি পূর্ণিমার চাঁদের সোনালি গায়ের উপর পরিষ্কার ফুটে উঠল। তারপরেই চাঁদ পেরিয়ে এক টুকরো কালচে মেঘের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার মুখ দেখে ওরা দু-জন চাঁচাতে লাগল। কী হল? কী হল? শরীর খারাপ হল নাকি? আমি বললাম, না। চাঁদে যাবার প্রথম নৌকোটাকে বোধ হয় দেখলাম। লটবহর নিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, গুপি, ছোটোমামা কি–
গুপি বলল, চোপ।
ছোটো মাস্টার তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, আচ্ছা, আমি তাহলে আসি। আমি থাকলে তোমাদের কথাবার্তার অসুবিধা হয়। তা ছাড়া, নাইট ক্লাসের আর বেশি দেরিও নেই। বলেই, বোধ হয় একটু রেগে হনহন করে চলে গেলেন।
খুব খারাপ লাগল। কিন্তু গুপি খুশি হয়ে বলল, যাক, বাঁচা গেল, লোকটা ঠিক ছিনেজোঁক, কিছুতেই তোকে ছাড়তে চায় না।
আমি বললাম, না রে গুপি। উনি রবিবার ছাড়া রোজ আমাকে দু-ঘণ্টা করে হাতের কাজ শেখাবেন। প্রথমে আমরা স্পেসশিপের মডেল বানাব। তারপর সেটাকে বড় করে বানাতে কতক্ষণ!
শুনে গুপিরও কী উৎসাহ!
আমি বললাম, আচ্ছা, ছোটোমামাকে তো আর একদিনও দেখতে পেলাম না, গুপি। চাকরি গেল নাকি?
গুপি বলল, আরে, না, না, তাই যায় কখনো! ছোটোমামা ভয়ংকর চালাক, প্রেসের ভিতরে আজকাল ওর দিনের বেলায় ডিউটি। বড়ো সাহেবকে পটিয়েছে। ক্যান্টিন দেখে। তারজন্যে পয়সা নেয় না, কিন্তু দু-বেলা খাবার পায়। বড় সাহেবরা যা খায়, ও-ও তাই খায়। চপ, কাটলেট, মুরগি ভিন্দালু, পুডিং।
দু-জনেই খানিকক্ষণ চুপ করে সেসব কথা ভাবতে লাগলাম। তারপর গুপি বলল, কিন্তু বড়ো মাস্টারের কী রাগ! ওকে চেনেন না, জানেন না, তবু কেবলই ছোটো সাহেবের কান ভাঙাতে চেষ্টা করবেন। স্রেফ হিংসে। ছোটোমামা খাবে ক্যান্টিনে, আর বুড়ো খাবে তেওয়ারির দোকানে, এই আর কী! সমস্তক্ষণ ছোঁকছোঁক করে ছোটোমামার পিছনে ঘোরেন, প্রুফ দেখেন না হাতি! একটু যে তদন্ত করবে, ছোটোমামা সে জো নেই!
আমি বললাম, কেন, রাতে তদন্ত করলেই হয়।
শুনে গুপির কী হাসি, তাহলেই হয়েছে! ছোটোমামার যা ভূতের ভয়! ও রাতে গলি দিয়ে নামল আর কী!
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তবে-না নাইট ওয়াচম্যানের বদলির কাজ নিয়েছিল বলেছিলি?
গুপি বলল, তাতে কী হয়েছে! সব নাইট ওয়াচম্যানরা ভূতের নামে জুজু। ছোটোমামা সিঁড়ির মাথা থেকেই চৌকিদারি করত। আগের ওয়াচম্যানই তাই বলে দিয়েছিল। সে-ও তাই করত। এখানকার রাতের পাহারাওয়ালারাই তাই করে। আর যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, তারা দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমোয়। মোট কথা ঠান্ডা ঘরে কীরকম স্পেসশিপ তৈরি হচ্ছে, আর কারাই-বা তৈরি করছে, এ বিষয়ে এতটুকু তদন্ত করার সময় পাচ্ছে না ছোটোমামা। তা ছাড়া ওই সরকারি ছাপাখানাটা কি কম পুরোনো ভেবেছিস নাকি। কোম্পানির আমলে ওটা এদিককার সবচেয়ে বড়ো গুদামঘর ছিল। মোটে আশি বছর হল ছাপাখানা হয়েছে। ভূতফুত থাকলে ওইখানেই থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ছোটোমামা রাতে শুয়ে শুয়ে হাঁচড়পাঁচড় উঁয়া-ঊয়া শব্দ শোনে। কোনদিন আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যায়।