তবু আমার দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। গুপি বলল, বাড়িতে বলে এসেছি তোর এখানে খাব শোব।
খাবার কোথায় পাব? ডুলিতে পাঁউরুটি থাকতে পারে।
–আরে দূর, ছোটোমামার কাছে খেয়ে এলাম এক্ষুনি। পরোটা কাবাব ক্ষীরের সন্দেশ।
এমনি চমকে গেলাম যে জিব কামড়ে ফেললাম। গুপি বলল, এসব কথা কাউকে বলবি না। ছাপাখানার ওই যে ঘোরানো সিঁড়ির মাথায় দরজা দেখছিস, ওটা ছোটোমামার ঘর। ছোটোমামা ছাপাখানার বদলি নাইট ওয়াচম্যানের চাকরি পেয়েছে। এই বলে গুপি মুখ চেপে বেজায় হাসতে লাগল। সবাই জানে ও আগের পাহারাওয়ালার ছোটো ভাই।
একটু পরেই আমার আরাম কেদারায় কুশন মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ে গুপি বলল, দাড়ি পরে কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে সে আর কী বলব। নকল দাড়ির নীচে সত্যি দাড়ি গজাচ্ছে। এই দু-দিনেই চমৎকার খোঁচা খোঁচা বেরিয়েছে। কিন্তু ভুলে যাস না যে ওর প্রাণ তোর হাতে। এই বলেই পাশ ফিরে গুপি দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
আমারও গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল! আমাকেও গুপির আর ছোটোমামার উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে। আস্তে আস্তে পা-দুটোকে গুটোতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আশ্চর্য হয়ে টের পেলাম, অন্য দিন কিছু হয় না, আজ কিন্তু পায়ের গুলিটাকে বেশ শক্ত করতে পারছি।
শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, কাল সকালে গুপিকে দেখে মা কী বলবেন। নিশ্চয় জানতে চাইবেন কোথা দিয়ে এসেছে! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সাতটা বেজেছে, রামকানাই আমার হরলিক্স এনেছে, গুপির কোনো চিহ্ন নেই। পরে জানলার কাছে গিয়ে দেখি তক্তাটাও নেই! তবে স্বপ্ন যে নয়, তার প্রমাণ গুপি তার ছেঁড়া চটি ফেলে, আমার আস্ত চটি পরে চলে গেছে। যাক গে, আমার চটিই-বা কী, আর জুতোই-বা কী! আমি তো দু-পায়ে ল্যাংড়া। একথা ভেবে বেজায় কান্না পাচ্ছিল। ভাগ্যিস রামকানাই ঠিক সেই সময় গরম গরম তিনকোনা পরোটা আর কাল রাতের বাকি দুটো মাংসের আলুচপ এনে হাজির করল, তাই মনটা আবার ভালো হয়ে গেল।
০৬-১১. ছোটো মাস্টারও রোজ আসেন
আজকাল ছোটো মাস্টারও রোজ আসেন। ডাক্তারবাবু বাবাকে বলেছেন যে আমাকে নানারকম ভালো হাতের কাজ শেখালে মনটন ভালো থাকবে, তাহলে ঠ্যাং দুটোও তাড়াতাড়ি সারবে। নাকি রোগটা ঠ্যাঙের নয়, মনের। মনের জোর হলেই পায়ের জোর হবে। কিছু বললাম না, কারণ হাতের কাজ শিখতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
আপত্তি তো নেই-ই, বরং আগ্রহ আছে বলা যায়। বড়ো মাস্টার বাবাকে বললেন, তলাপাত্র যন্ত্রপাতি গাড়ি ইত্যাদির ছোটো ছোটো মডেল তৈরি করতে ওস্তাদ। আমাদের নাইট স্কুলের বড়ো ছেলেদের দিয়ে রেলগাড়ি আর এঞ্জিনের যে খাসা মডেল করিয়েছে, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।
বাবাকে দেখাবার জন্যে মডেলটা আনলেনও বড়ো মাস্টার। দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অবিকল একটা রেলগাড়ি। দরজা, জানলা, স্প্রিং, চাকা, আলো, পাখা, জলের ট্যাঙ্ক, লাইন, ব্রেক, অ্যালার্ম সিগনেল, ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের যাবতীয় কিছু একেবারে হুবহু সত্যিকার গাড়িতে যেমন থাকে। রং টং দিয়ে তৈরি। আমার ঘরের মেঝেতে লাইন বসিয়ে, প্লাগ লাগিয়ে সেই গাড়ি চালানো হল। তার বাঁশিটি পর্যন্ত অবিকল। কী বলব, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
সেদিন রাতে মা-বাবার মুখে ছোটো মাস্টারের প্রশংসা আর ধরেনা। এতদিন চোর চোর চেহারা, সোজা তাকায় না কেন,ইত্যাদি কী না বলেছেন সবাই। আজ একেবারে উলটো কথা। তখনই ঠিক হয়ে গেল ছোটো মাস্টার রোজ বিকেলে নাইট স্কুলে যাবার আগে, আমাকে ঘণ্টা দুই হাতের কাজ শেখাবেন। ভালোই হল; ওই সময়টাই আমার ভালো কাটত না। আগে ওই সময়টা খেলার মাঠে কাটত। রোজ চারটে থেকে ছ-টা যদি মডেল তৈরি করা যায়, বিশেষত ছোটো মাস্টারের সঙ্গে, তাহলে মন্দ কী। তা ছাড়া আমার আরেকটা মতলবও আছে।
প্রথম দিন ছোটো মাস্টার এসে কিছু বলবার আগেই আমি বললাম, স্পেসশিপের মডেল করা যায়না?
ছোটো মাস্টার একটু হকচকিয়ে গেলেন। একেবারে স্পেসশিপ দিয়েই শুরু করবে নাকি? আগে ছোটোখাটো দুটো-একটা জিনিস করলে হয় না?
আমি বললাম, বেশ তো, আগে ছোটোখাটো জিনিস দিয়েই নাহয় শুরু করা যাবে। ওই যে সেদিন পাক-খাওয়ার মেশিনের কথা বলছিলেন, তাই দিয়েই আরম্ভ করা যাক। ওই বইটাতে তার ছবিও আছে।
অন্য কেউ হলে হয়তো বকাবকি করত। কিন্তু ছোটো মাস্টার বললেন, আচ্ছা, তাই হবে। তাহলে বইটা থেকে ওই যন্ত্রটার পার্টগুলোর ছবি আগে এঁকে নিতে হবে। কাগজ পেনসিল রবার সবই তো আছে। মাপ নেবার জন্য কম্পাস ইত্যাদিও লাগবে। ওই মাপেই এঁকো।
তারপর এক বার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি সত্যি যাবার ইচ্ছা আছে দেখছি। কাগজে দেখলাম অ্যামেরিকানরা সম্ভবত এ বছরই চাঁদে মানুষ নামাবে।
আমি আরেকটু হলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই উঠছিলাম। পিছনটাকে চেয়ার থেকে খানিকটা বোধ হয় তুলেই ফেলেছিলাম। কিন্তু সে কথা মনে হতেই ধপ করে আবার চেয়ারের উপর পড়ে গেলাম। ছোটো মাস্টার সব দেখলেন। বললেন, লাগেনি তো? চাঁদে যাবে বলে যে সবার আগে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। তা ছাড়া নিজেদের স্পেসশিপে করে যেতে হলে একটু দেরি তো হবেই। বৈজ্ঞানিকরা আগে গিয়ে দেখেই আসুক না সেখানকার অবস্থাটা কীরকম। কী বলো? সেই বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। মাটির নীচে উপনিবেশ করতে সময় নেবে।