মেজোকাকু বললেন, তাহলে কোথা থেকে কিনেছে সেটা জানা দরকার। অর্থাৎ ওকে ধরা দরকার। যাই, দেখি নিতাই কী বলে।
মেজোকাকু চলে গেলে বড়ো মাস্টারমশাই বললেন, ও কী পানু, অত মনমরা কেন? ওই ছেলেকে ধরবে নিতাই সামন্তরা? তাহলেই হয়েছে! ওদের ও এক হাটে কিনে আরেক হাটে বেচে আসতে পারে। তোমাদের চাদে যাওয়ার কোনো অসুবিধাই হবে না। অবিশ্যি চাঁদে যাওয়াটা আমি কোনোদিনই সমর্থন করব না। তা ছাড়া পায়ের এক্সারসাইজগুলো করছ তো? নইলে চাদে যাবেই-বা কী করে? কী বললে তলাপাত্র, মুখ তুলে কথা বল না কেন? তোমাকে তো আর আমি খেয়ে ফেলব না!
ছোটো মাস্টারমশাই ভয়ে ভয়ে বললেন, ওই যে বর্মার গল্পটা
–কোনটা? ওই ফুঙিদের মাছের গল্পটা?
-না, না, ওই যে যখনই কী হয় তখনই আরেকটা কী হয়—
বড়ো মাস্টার খুব হাসলেন, ও সেইটে। বুঝলে পানু, বি.এ. পাস করিয়ে, বাবা আমাকে কিছুদিন রেঙ্গুনে রেখেছিলেন। ওখানে আমাদের একটা আপিস ছিল। আপিসটা দেখতে ছোটো, একটা এত সরু গলির মধ্যে যে তার ভিতর মোটর গাড়ি ঢুকত না। কিন্তু সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার আমদানি-রপ্তানি কারবার হত। লোক গিজগিজ করত গলিটিতে। একদিনে এত কোটি কোটি টাকার লেন-দেন বর্মায় আর কোথাও হত না। আমাদের থাকার জায়গা ছিল ওপর তলায়। পাশাপাশি দুটি বেশ বড়ো ঘর, রান্নাঘর, স্নানের ঘর। তা তোমাদের বউঠান কিছুতেই একা বেরুবে না, সবটাতেই তার বেজায় সন্দেহ। বুঝলাম লোক রাখতেই হবে, এবং যত পুরোনো লোক হয় ততই ভালো। দুঃখের বিষয়, লোকরা যেই একটু পুরোনো হয়, রাধাবাড়ায় হাত পাকায়, অমনি বলা নেই কওয়া নেই কোথায় উধাও হয়। তারপর কিছুদিন ভারি অসুবিধা, লোক পাওয়া যায় না! তোমাদের বউঠান রাঁধে খাসা, কিন্তু হাটবাজার আমাকে করতে হত। এদিকে কাজের এতটুকু ক্ষতি হলেই, বাবা হয়তো রেগেমেগে ত্যাজ্যপুত্র করে দেবেন।
এবাড়ি-ওবাড়ি জিজ্ঞাসা করে টের পেলাম, শুধু আমাদের বাড়িতে নয়, সব বাড়ির ওই এক অবস্থা। মাস তিনেক ওইভাবে চলে, তারপর আস্তে আস্তে আবার লোক পাওয়া যায়। ভাবলাম এ-দেশের ওই রকমই ব্যাপার, এরা ছয় মাস কাজ করে তো তিন মাস দেশে বসে খায়।
দু-বছর এইভাবে চলল, তারপর সালওয়েন নদীতে মানপু বলে একটা ছোটো জায়গায় যেতে হল। একাই গেলাম, পরিবার নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়, বেজায় ডাকাতের উপদ্রব। পৃথিবীতে যেখানেই যাওয়া যাক না কেন, একটা-না-একটা ঝামেলা থাকে। ওইখানে আমাদের কাঠগুদোম ছিল, বন্দুকধারী পাহারাওয়ালা রাখতে হত, নিজেদেরও যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হত। ডাকাতির ঢেউ আসত। মাস তিনেক খুব ডাকাতি, তারপর ছয় মাস সব চুপচাপ। তারপর আবার ডাকাতি। আমরাও তাই বুঝে কাজ গুছিয়ে নিতাম, ওই ছয় মাসের মধ্যে টাকাকড়ির লেন-দেন সেরে ফেলতে চেষ্টা করতাম। রেঙ্গুনের চাকর পালানোর আর মানপুর ডাকাতির কোনো সম্বন্ধ আছে কেউ সন্দেহও করতাম না। বছর পাঁচেক বাদে রেঙ্গুনে একজনদের চাকর হঠাৎ মারা গেলে, তার জিনিসপত্রের মধ্যে এমন সব চোরাইমাল বেরুল যাতে আর কোনো সন্দেহই রইল না যে যারা ছয় মাস ভালোমানুষ সেজে রেঙ্গুনে লোকের বাড়িতে কাজ করত, তারাই মানপুতে তিন মাস দুর্ধর্ষ ডাকাতি করত। কাজেই কীসের সঙ্গে কীসের সম্বন্ধ আছে কিছুই বলা যায় না। চলো হে তলাপাত্র, তোমাকে ভূতের গলিটা পার করে দিয়ে আসি।
ওঁরা চলে যাবার আধ ঘণ্টা পরে রামকানাই আমার জন্যে হরলিক্স নিয়ে এল। মুচকি হাসতে হাসতে বলল, যত সব বিদ্যেদিগগজ হয়েছেন।
আমি বললাম, কী যে বল, রামকানাই, বড়ো মাস্টার কত দেশ ঘুরেছেন, কতরকম দেখেছেন।
রামকানাই বলল, মুখে যত বউয়ের উপর দয়া, আর ওদিকে একবার তাকিয়ে দেখো-না। দু-মুখো সাপ। আজ আমি কিন্তু রাতে তোমার ঘরে শোব না, যাত্রা দেখতে যাব। ভয় করে তো বুড়ো মাস্টারকে ডাকতে পার। বড়ো মাস্টারমশাইকে ভক্তি করি বলে রামকানাইয়ের যত রাগ।
তবু ওঁদের জানলার দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। এত দূর থেকে কথা শোনা যায় না, শুধু ছায়ার মতো দেখা যায়। মনে হল বকবার আঙুল তুলে মাস্টারমশাই বউকে শাসাচ্ছেন। বড়ো কষ্ট হল।
সে-রাতে আর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বার বার উঠে বসে জানলা দিয়ে দেখছিলাম, বড়ো মাস্টারমশাইয়ের ঘরে তখনও আলো জ্বলছে আর বড়ো মাস্টারমশাই ঘরময় অস্থিরভাবে পাইচারি করছেন। একবার তন্দ্রামতো এসেছিল, চমকে জেগে উঠলাম। কে ঠোঁট চেপে শিস দিচ্ছে শ শ ট শ শ ট। এ তো গুপির আর আমার গোপন সংকেত। এত রাতে গুপি কী করে এল? হাতে ভর দিয়ে এক লাফে গাড়িটাতে চড়ে জানলার কাছে গিয়ে দেখি যা ভেবেছি ঠিক তাই। গুপি ছাপাখানার ঘোরানো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, কাঁধে একটা তক্তা। আমি ইশারা করে ডাকতেই তক্তাটা যথাস্থানে ফেলে স্বচ্ছন্দে ফাঁকটুকু পার হয়ে আমাদের ঘোরানো সিঁড়িতে এসে উঠল। বাবা! ওই তিন তলার উপরে সরু তক্তার উপর দিয়ে ওকে ঘঁটতে দেখে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ! আমাদের সিঁড়িতে উঠে আবার ঝুঁকে তক্তাটাতে টান দিল। দেখি এ মাথাটা আমাদের রেলিংএর সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। ওইখানেই তক্তাটা ঝুলতে লাগল।
আমার শোবার ঘরের পাশেই খাবার ঘর, তার বাইরে সরু বারান্দা। কার্নিশ বেয়ে দুই হাত হেঁটে সেই বারান্দায় উঠতে গুপির পাঁচ মিনিটও লাগল না। আমি খাবার ঘরের দরজার নীচু ছিটকিনিটা খুলে দিলাম। গুপি ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে আস্তে আস্তে আমার ঘরে এল। খাবার ঘরের পর বসবার ঘর, তার ওপাশে মা-দের ঘর।