আরও সাত দিন কেটে গেল, নেপোর কোনো পাত্তা নেই। মেজোকাকু বললেন, একটা পার্সিয়ান ক্যাট এনে দিই, কী বলিস? বাড়ি ছেড়ে এক পা নড়বে না, এই বড়ো সাইজের, ছাই রঙের গা, নীল চোখ। বেড়ালকে বেড়াল, কুকুরকে কুকুর। পাতি বেড়াল কেউ পোষে নাকি?
খুব দুঃখ হল। বললাম, কেন পুষবে না? আমাদের এই বাড়িতে আটটা ফ্ল্যাট, প্রত্যেকের একটা করে বেড়াল ছিল। এখন অবিশ্যি সবার নেই। তিন নম্বর, চার নম্বর আর সাত নম্বরের বেড়ালও অদৃশ্য হয়ে গেছিল, তবে তারা ফিরে এসেছে। বিদঘুঁটে তাদের খায়নি, রামকানাই যাই বলুকনা কেন।
ছোটো মাস্টার বললেন, এ তো ভারি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আপনার বন্ধু নিতাই সামন্ত এই নিয়ে একটু তদন্ত করতে পারেন।
মেজোকাকু চটে গেলেন, রেখে দিন ওসব বাজে কথা। সে এখন নিজের কাজ ফেলে বেড়ালের পিছন ঘুরুক আর কী!
বড়ো মাস্টারমশাই না থাকলে ছোটো মাস্টারের বেজায় সাহস বেড়ে যায়। তিনি বললেন, আহা, এমনও তো হতে পারে যে গাড়ি চুরি আর বেড়াল চুরি দুটো আলাদা ব্যাপার নয়?
মেজোকাকু অবাক হয়ে ছোটো মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক সেই সময় বড়ো মাস্টার এসে ঢুকলেন। মেজোকাকু তাকে তলাপাত্রের মন্তব্যটা বলে খুব হাসতে লাগলেন।
বড়ো মাস্টারমশাই বেশ গম্ভীর মুখেই বললেন, তাহলে বুঝতে হবে কি যে এখনও নেপোকে পাওয়া যায়নি আর তলাপাত্রের মতে চোরাই গাড়ি আর হারানো বিল্লি একসঙ্গে পাওয়া যাবে? তা কিন্তু কিছুই বলা যায় না। হয়তো চোরাই গাড়ির গোপন কারখানায় ইঁদুরের উপদ্রবে টেকা যাচ্ছিল না বলে ওরা বেড়াল আমদানি করছে। কী বলো তলাপাত্র?
তলাপত্র লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে চুপ করে রইল। বড়ো মাস্টার বললেন, তা হলে শোনো। বর্মায় একবার দেখা গেল যখনি–
এইটুকু বলেছেন, এমনি সময় হন্তদন্ত হয়ে গুপি এসে উপস্থিত। তার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারলাম। একটা কিছু হয়েছে। সে ভীষণ উত্তেজিতভাবে বলল, ছোটো মাস্টারমশাই, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। এক্ষুনি দেখলাম দু-তিনজন লোক জালে জড়িয়ে ছোটো ছোটো জ্যান্ত মাছ নিয়ে ঠান্ডাঘরের গলিতে ঢুকল। ওখানে যে পেঙ্গুইন গজিয়েছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।
বড়ো মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, কী বলেছে তলাপাত্র? ঠান্ডাঘরে পেঙ্গুইন গজিয়েছে? মাছ গজায়নি?
তলাপাত্র আস্তে আস্তে বললেন, না স্যার, জল ছাড়া মাছ বাঁচবে কী করে?
বড়ো মাস্টার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাবা-মা ফিরে এলেন। আরে গুপি, তুই এখানে? এদিকে যে তোর ছোটোমামাটি এবার সত্যি ফেরারি হয়ে গেছে সে খবর রাখিস?
বাবা খুব হাসতে লাগলেন। কিন্তু আমাদের হাত-পা জমে বরফ। ছোটোমামা ফেরারি হলে আমাদের চাঁদে যাওয়ার কী হবে? বাবা একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, সে এক কাণ্ড, মশাই। বইয়ের সঙ্গে চাঁদু ছোকরার সম্বন্ধ নেই, খালি অলিগলিতে ঘুরবে আর যত রাজ্যের রাবিশ কিনে আনবে। যত সব মলাট-ছেঁড়া বাজে বই আর জংধরা লোহার টুকরো। নিজের ঘরটাকে ছাদ অবধি বোঝাই করে ফেলছে। তারপর কাল একেবারে বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি! বাছাধন বাজারের থলি বোঝাই পেরেক শেকল ইত্যাদি নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। তাও সোজা পথে না, জলের পাইপ বেয়ে। আর পেছন থেকে বেল্টখামচে ধরেছেন প্রাণেশবাবু!
বড়োমাস্টার বললেন, তিনি কে?
-কে আবার, ছোটোমামার বাবা, অর্থাৎ গুপির দাদু! বুড়ো তো চটে কই। হতভাগা কিছুতেই পড়বে না! পাছে পালায় তাই ঘরের শেকল তুলে দিয়েছিলেন, জানলা দিয়ে বেরিয়ে পাইপ বেয়ে পালাল!! ছেলের হাত থেকে থলি পড়ে পেরেক ছড়িয়ে একাকার। তাই দেখে বুড়োর হাতও হয়তো একটু ঢিলে হয়েছিল, অমনি হ্যাঁচকা টানে বেল্ট ছিঁড়ে ছোকরা পগার পার! সারা রাত সারা দিন গেছে ছেলের দেখা নেই। ও-বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। তুই বলতে চাস, তুই কিছু জানিস না, গুপি?
গুপি তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলল, আমি কী করে জানব? আমরা থাকি হেদোর কাছে আর দাদুরা বাদুড়বাগানে। যাই, অনেকগুলো হোমটাস্ক করতে হবে। এই বলে দৌড়।
গুপি চলে গেলে বাবা বললেন, ওই দুষ্টু মামা আর তার এমন ভালো ভাগনে! গুপির মতো হতে চেষ্টা করিস পানু। তারপর মেজোকাকুকে বললেন, আসল কথাই বলতে ভুলে গেলাম। চাদুর ঘর সার্চ করা হয়েছে, যদি কোথায় গেল তার কোনো ক্ল পাওয়া যায়। লোহার স্কুপের নীচে থেকে দুটো ভাঙা মোটর গাড়ির নম্বর প্লেট পাওয়া গেছে। দুটোই চোরাই মোটরের নম্বর প্লেট।
মেজোকাকু বললেন, সে কী! কী করে জানলে?
–আরে, চাঁদুর মা এমন কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছেন যে শেষপর্যন্ত বুড়ো থানায় গিয়ে ছেলে হারানো ডাইরি করে এলেন। সেখানে সবাই হেসেই কুটোপাটি, হারিয়েছে আবার কী, পেলিয়েছে বলুন। ওইখানেই তোর বন্ধু নিতাই সামন্তর সঙ্গে দেখা। সে-ই ঘর সার্চ করে নম্বর প্লেট বের করেছে আর ফর্দ মিলিয়ে দেখেছে দুটোই হারানো গাড়ির নম্বর প্লেট। কাজেই সঁদুর পেছনে এবার হুলিয়া লেগেছে। শুধু যে ঘর-পালানো ছেলে তা তো নয়, একেবারে ফেরারি আসামি। ধরা পড়লেই হাতে হাতকড়া।
শুনে সবাই থ। বাবা একটু হেসে, উঠে গেলেন। তখন আমি বললাম, তা হতে পারে না। আমরা চাদে যাব বলে ছোটোমামা স্পেসশিপ বানাবেন, তাই পেরেক-টেরেক জমা করছেন। ওসব জিনিস উনি নিজের টিপিনের পয়সা দিয়ে সের দরে কেনেন। কোথা থেকে ওগুলো কিনেছেন বের করতে পারলেই গাড়িচোরও বেরিয়ে পড়বে।