লোকটা দেখলাম আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। মেমসাহেবকে যখন টাকা দিলাম লোকটা ঝুঁকে ব্যাগের মধ্যে দেখতে দেখতে বলল–চেঞ্জ গুনে নেবেন, বেটিরা ভারি হঁচড়। মেম রেগে এ-গাল থেকে ও-গালে চুইংগামটা ঠুসে দিয়ে বলল– চোপরাও বাবু। তারপর লোকটা আমাকে সেইরকম যত্ন করে উপদেশ দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে নিয়ে চলল। একটা কলার খোসা আর কী যেন খানিকটা খুব কসরত করে এড়িয়ে বলল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। সবাই সবারটা গিলবার ফিকিরে আছে। গেটের কাছে চেকারবাবু চিকিৎ চিকিৎকরে টিকিট হেঁটে দিলে পর আমার সঙ্গে সঙ্গে সেও প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। বলল–এই যে গাড়ি–অবিশ্যি সেটা বলবার কিছু দরকার ছিল না।
আমার সঙ্গে একটা ইন্টার ক্লাস গাড়িতে ঢুকে আমার পাশে বসে বলল- জিনিসপত্র আগলে রাখুন, সুটকেসটা দূরে রাখবেন না, নিজের সিটের তলায় রাখাই ভালো। এটা জেনে রাখবেন শিয়ালদা স্টেশন চোর-বাটপাড়ের আড়ত। তারপর আমরা দুজনেই জুতো খুলে পা তুলে আরাম করে বসলে পর বলতে লাগল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। আমি নিজে যতগুলো চোর-জোচ্চর দেখেছি সবগুলোকে একটার পেছনে একটা দাঁড় করালে এখান থেকে বোলপুর স্টেশন অবধি লম্বা একটা লাইন হয়। একথা শুনে আমি অবাক হলাম।
তখন সে আরও বলতে লাগল, আর ছিচকে চুরির জন্য তারা যে অধ্যবসায়, ধৈর্য ও বুদ্ধি দেখিয়েছে, ভালো কাজে যদি লাগাত এতদিনে ভারতবর্ষ উদ্ধার হয়ে যেত।
তারপর তার কালো কোটের পকেট থেকে একটা চারকোনা পানের ডিবে বের করে বলল গিরিডির মতন সভ্য শহরে, যে জায়গা সজ্জনের বাস বলে বিখ্যাত এমন শহরে, সেবার পুজোর সময়ে সচ্চিদানন্দ জ্যাঠামশাইয়ের পাজামা সুটের ইজের গা থেকে খুলে চোরে নিয়ে চলে গেল, এর বেশি আর কী বলা যায়!
আমি নিবিষ্ট মনে শুনতে লাগলাম। আর সে গোটা দুই পান মুখে পুরে, একটু চুন দাঁতে লাগিয়ে বলে যেতে লাগল– গরমের জন্য বাইরে মাদুর পেতে, তায় চাদর বিছিয়ে, বালিশ মাথায়, চাদর গায়, পায়ের কাছে চটি, বালিশের নীচে হাতঘড়ি, মাথার কাছে জলের গেলাশ নিয়ে, ভগবানের নাম নিয়ে রোজকার মতন শুয়ে পড়েছেন। আর সকালে উঠে দেখেন কিনা চটি নেই, গেলাশ নেই, বালিশ নেই, হাতঘড়ি নেই, এমনকী পরনের ইজেরটা পর্যন্ত কখন যেন আস্তে আস্তে খুলে নিয়েছে!
তখন সে বলল–কাউকে মশাই বিশ্বাস করা যায়? অরুণবাবু ট্রেনে করে আসছেন। সেকেন কেলাস গাড়ি, সঙ্গে উঠলেন দিব্যি খাকি প্যান্ট শার্ট হ্যাঁট পরা বাঙালি সাহেব। ক্যায়সা ভাব জমে গেল দেখতে দেখতে। ইনি ওঁর বিস্কুট খেলেন, আবার উনি এঁর সিগারেট টানলেন। তারপর মুড়ি-সুড়ি দিয়ে দু-জনে ঘুম। সকালে উঠে অরুণবাবু দেখলেন বাঙালি সাহেবও নেই, তার জিনিসপত্রও নেই, আর অরুণবাবুর সুটকেশও নেই।
আমি একবার আমার সুটকেস ও পুঁটলিটা দেখে নিয়ে ঠ্যাং বদলে বসলাম। আর সে বাইরে এঁদো পুকুরে ধোপাদের কাপড় কাঁচা দেখতে দেখতে নীচু গলায় বলতে লাগল।
ছোটোবেলায় পাড়াগাঁয়ে পিসিমার কাছে থাকতাম। গ্রামের একধারে বাঁশঝাড়ের কাছে খড়ের চালের বাড়ি। যেই-না সন্ধ্যে হওয়া আর অমনি বাড়ির আর উঠোনের আনাচে-কানাচে ভয়ভীতিরা ভিড় করে আসত। বাঁশঝাড়ের শুকনো পাতা খসার শব্দ থেকে আরম্ভ করে আমাদের মেনি বেড়ালটারকাঁক করেইঁদুর ধরার আওয়াজটা পর্যন্ত সূর্য ডোবার পর কেমন যেন অন্যরকম লাগত। আরপিসিমা শোবার আগে প্রত্যেক ঘরের প্রত্যেকটা খিল ভালো করে দেখে নিতেন, বাক্স প্যাটরার উপর নানানভাবে ঘণ্টা বাসন সব এমন করে সাজিয়ে রাখতেন যাতে একটু সরালেই সব দুমদাম পড়ে আমাদের কেন, পাড়ার অন্য লোকদেরও ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এইসব করতে করতে পিদ্দিমের তেলটুকু পুড়ে যেত আর আলো নিবে যেত। পিসিমাও অমনি খচমচ করে বিছানায় ঢুকতেন। মাঝে মাঝে ওঁর ঠান্ডা খড়খড়ে পা আমার পায়ে লেগে যেত, আমি শিউরে উঠতাম। শুয়েই আবার পিসিমার মনে হত–কী হবে, খাটের তলা দেখা হয়নি, যদি কোনো ধূর্ত চোর ছোরা-হাতে সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে! আমাকে বলতেন–এই, তোর একটা মার্বেল খাটের তলা দিয়ে গড়িয়ে দে না, ওদিক দিয়ে বেরোলে বুঝব খাটের তলায় কেউ নেই।ভয়ে আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যেত, পিসিমা যা বলতেন তাই করতাম। একবার খাটের পায়ায় মার্বেল আটকে গেল, আর সারারাত পিসিমা আর আমি জেগে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। আর কখনো যদি পিসিমা আগে শুতেন আর আমাকে অন্ধকারে পরে শুতে হত, খাটের তিন হাত দূর থেকে এক লাফ মেরে খাটে উঠে পড়তাম, যাতে খাটের তলায় লুকিয়েবসা বদমায়েশটা তার ঠান্ডা হাত দিয়ে আমার ঠ্যাং ধরে টেনে নিতে না পারে। একদিন হিসেব ভুল হওয়াতে পিসিমার পেটের উপরল্যান্ড করেছিলাম, আর পিসিমা আমার কানটান মলে বার বার বলতে লাগলেন যে উনি পষ্ট টের পাচ্ছেন ওঁর নাড়িভুঁড়ি সব এলিয়ে গেছে!
এতটা বলে লোকটা এক বার আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল–ছোটোবেলা থেকে এমনি আমার ট্রেনিং যে কোনো শা–র চোরও আমার কাছ থেকে কানাকড়িও পায়নি! এই দেখুন নোটের তাড়া নিয়ে নির্বিঘ্নে যাচ্ছি!
এই অবধি বলেই হঠাৎ সে এদিক-ওদিক চেয়ে সটাং শুয়ে পড়ে নাক ডাকতে লাগল। গাড়িতে আর যে দু-চারজন ছিল তারাও সবাই একসঙ্গে নেমে গেল। আর আমিও আমার যে দু-একটা কাজ ছিল সেরে নিয়ে অন্য এক বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম ও একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।