খোঁজ নিয়ে জানলুম পানুদা সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে। নিয়ম করে ক্লাসের লাস্ট বয়ের ঠিক উপরে হয়। কিন্তু তার মন খুব ভালো, লাস্ট বয়কে খুব সাহায্য করে। আমাদের ঘরের নীলু বলল, সেই সাহায্যের ফলেই নাকি লাস্ট বয় বেচারা চিরটা কাল লাস্টই হচ্ছে!
যাই হোক, আমি এ-সমস্ত কথা বিশ্বাস করিনি, কারণ আমাদের ঘরে দেখতাম তার খুব বুদ্ধি খোলে। নিজে লুকিয়ে ডিটেকটিভ বই পড়তে আর আমরা কোনো অন্যায় করলে ধরে ফেলতে তার মতন ওস্তাদ আর দুটি হয় না। এই পানুদাই যেদিন বিপদে পড়ল, আমরা তো সবাই থ! সে এক অদ্ভুত আশ্চর্য ব্যাপার!
পানুদা আর তার গুটি পাঁচেক ক্লাসের বন্ধু প্রায়ই ভোজ মারে। সবাই মিলে টাকা জমিয়ে পানুদার কাছে দেয় আর এক শনিবার বাদে এক শনিবার চপ, কাটলেট, ডিমের ডেভিল– আরও কত কী-র ব্যবস্থা হয়! আমায় একবার একটা ঠোঙা ফেলতে দিয়েছিল, আমি সেটা একটু শুকে আর একবার চেটে সারারাত কী পেলুম না, কী পেলুম না করে আর ঘুমুতে পারিনি।
পানুদার কাছে তো পিঁপড়েটি আদায় করা দায়, তাই আমরা ছোটো ছেলেরা নিজেরা একবার পয়সা জমাতে চেষ্টা করেছিলাম। সে আর এক কেলেঙ্কারি! জগা আজ চার আনা দিল, আবার কাল বলে, দে বলছি আমার চার আনা, আমি পেনসিল কিনব। যত বলি পেনসিল কিনবি কীরে, ও দিয়ে যে আমরা চপ কাটলেট খাব রে! জগা বলে, ইয়ার্কি করবার আর জায়গা পাসনি! দে বলছি, নইলে এইসা এক রদ্দা কষিয়ে দেব! পারলে বোধ হয় চার আনার জায়গায় ছ-আনা নেয়। এমনি করে আমাদের সাড়ে তিন আনার বেশি জমলই না। তাও জমত না, নেহাত মন্টুর জ্বর-টর হয়ে বাড়ি চলে গেল, আর পয়সাগুলো চেয়ে নিতে ভুলে গেল।
যাই হোক, পানুদারা এদিকে সাড়ে তিন টাকা জমিয়েছিল। রাত্রে শুনলাম পাশের খাট থেকে পানুদা বলছে– আট আনার বরফি, আট আনার চিংড়ি মাছের কাটলেট, চার আনার ছাঁচি পান শুনে শুনে আমার গা জ্বলতে লাগল। জিভের জল গিলে গিলে পেটটা ঢাক হয়ে উঠল।
পরদিনই কিন্তু পানুদা বিষম বিপদে পড়ল। লাইব্রেরিতে পানুদা আর সমীরদা আর কে যেন একটা ছেলে পেল্লায় আড্ডা দিচ্ছে, পানুদা চাল মেরে কী-একটা কুস্তির প্যাঁচ দেখাতে গেছে আর স্লিপ করে কাঁচের আলমারির দরজা-টরজা ভেঙে চুরমার! পানুদা উঠে দাঁড়িয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছে, এমন সময়ে হেডমাস্টারমশাই এসে এমনি বকুনি লাগালেন যে পানুদা চমকে গিয়ে নিজের আলজিভ-টিভ গিলে বিষম-টিষম খেয়ে যায় আর কী! হেডমাস্টারমশাই এমনি রেগে গিয়েছিলেন যে এসব কিছু না দেখে বললেন– বাঁদুরে ব্যাবসা ছেড়ে এখন মানুষের মতন ব্যবহার শেখো। তোমাকে বেশি জরিমানা কোত্থেকে আর করি, কিন্তু তোমার বাক্সে যা টাকাকড়ি আছে সমস্ত দিয়ে যতগুলি কাঁচ হয় কিনে দেবে, তা দিয়েও যে অর্ধেকের বেশি হবে তা তো মনে হয় না।
সেদিন পানুদার মেজাজ দেখে কে! রাত্রে আমরা ঘরে বসে শুনলাম সিঁড়ি দিয়ে পানুদার চটির শব্দ–অন্যান্য দিনের মতন চটচট চটাং চটচট চটাং না হয়ে একেবারে চটাং চটাং চটাং! বুঝলাম পানুদা রেগেছে।
যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দেখলাম আসলে আরও ঢের বেশি রেগেছে। ঘরে ঢুকেই পানুদা আমার আর কেষ্টর মাথা একসঙ্গে ঠুকে দিয়ে বললে অত হাসি হাসি মুখ কেন রে বেয়াড়া ছোঁড়ারা? আমরা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেলাম। তারপর পানুদা জগার দিকে চেয়ে বলল, ফের ফোঁস ফোঁস করছিস রাস্কেল? বলে তার কানে দিল এক প্যাঁচ। হিরু বলল, ওর সর্দি হয়েছে কিনা–পানুদা তার গালে এক চড় কষিয়ে দিয়ে বলল-চুপ কর বেয়াদপ, তোর কে মতামত চেয়েছে?তারপর সময় কাটাবার জন্য শিবুর কানের কাছে খোঁচাখোঁচা চুলগুলো নখ দিয়ে কুটকুট করে টানতে টানতে দাঁতে দাঁত ঘষে বললে– আজ তোদের কাছ থেকে যদি টু শব্দটি শুনি, সব ক-টাকে কচুকাটা করে ফেলব বলে রাখলাম।
ঘরের মধ্যে একদম চুপ। পানুদা খাটে বসে পা দোলাতে লাগল আর বোধ হয় হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবতে লাগল। এমন সময়ে সেই গণশাটা এসে হাজির। এসেই পানুদার পিঠ থাবড়ে একগাল হেসে বললে– কী রে পেনো, ফিস্টিটা ভেস্তে গেছে বলে বুঝি মুখোনা হাঁড়ি আর কচি ছেলের উপর উৎপাত? রোজ বলি:ওরে পেনো, একা একা অত খাসনি!
পানুদা গুম হয়ে রইল।
গণশা বলল– তাই বলে কি টাকাগুলো সত্যি দিবি না কি?
পানুদা বলল, দেব না তো কি তুমি আমার হয়ে দিয়ে দেবে?
গণশা হেসে বললে, আরে রামঃ! এমন এক উপায় বাতলাতে এলুম, তোকেও দিতে হবে না, আমাকেও দিতে হবে না। আজ রাত্রে দরজা খুলে শুবি, দেখবি একটা ডাকাত এসে সব টাকা নিয়ে যাবে। পরে হয়তো ফিরে পাবি, কিন্তু ডাকাতটাকে খাওয়াতে হবে বলে রাখলুম।
পানুদা হাঁ করে খানিক তাকিয়ে বলল–সে দেখা যাবে এখন। এ সময়ে তুমি এঘরে যে বড়ো এসেছ, জানো না রুল থ্রি?
গণশা বললে– সাধে শাস্ত্রে বলে কদাচ কাহারও উপকার করিয়ো না।
মুখে পানুদা যতই তেজ দেখাক না কেন, শোবার সময়ে দেখলুম দরজাটা ঠিক খুলে শুল। অন্য দিন তো পারলে জানলাও বন্ধ করে, আমাকে দিয়ে খাটের নীচে খোঁজায়, রাত্রে উঠবার দরকার হলে জগাকে আগে একবার পাঠায়, আর সেদিন দেখি বেজায় সাহস! বালিশে মুখ গুঁজে একটু হেসে নিলাম।
উৎসাহের চোটে আমার অনেকক্ষণ ঘুম হয়নি, অনেক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি কে যেন টর্চের আলো ফেলেছে। পানুদা ভোঁসভাঁস করে ঘুমোচ্ছে আর বাকিরা কেউ যদি জেগেও থাকে। ভয়ের চোটে চোখ বুজে পড়ে আছে। আমি দেখলুম কে একটা লোক পা টিপে টিপে এসে পানুদার বালিশের তলা থেকে চাবি বের করল, পানুদার বাক্স খুলল, কী যেন নিল, আবার বাক্স বন্ধ করে চাবি বালিশের নীচে রেখে আস্তে আস্তে চলে গেল। পরদিন সকালে ইস্কুলময় হইচই, পানুদার টাকা চুরি গেছে। হেডমাস্টারমশাই সবাইকে ডেকে যাচ্ছে-তাই করে বলেন, সকলের বাক্স খোঁজা হল। কোথাও কিছু নেই। গণশার বাক্সে তো এত কম জিনিস, এবং তাও এত নোংরা যে তাই নিয়ে গণশা। বেজায় বকুনি খেল।