আমার মন পাখির মতন উড়ে যেতে চাচ্ছিল।
একচোখা বলল: কিন্তু শুধু তিমি মারলে হবে না। তার বহু অসুবিধাও আছে, বহু দূরও। এই কাছাকাছি মানুষ-টানুষ মারতে পারবে? পরে যাবে আফ্রিকা, নরওয়ে, আলাস্কা– আপাতত অন্ধকার রাত্রে গলির মুখে দাঁড়িয়ে বাঁকা ছুরি হাতে নিয়ে ঘচ করে সেটাকে লোকের বুকে আমূল বসিয়ে দিতে পারবে? যেমন রক্তের নদী ছুটবে তুমিও হো হো করে রাত কাপিয়ে কাষ্ঠ হাসি হেসে। উঠবে? মাথায় বাঁধা থাকবে লাল রুমাল?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সেই কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: উত্তর মেরুতে সিল মাছেরা বরফের মধ্যে বাসা করে—
আমি বললাম: কুড়ি বছর পরে উত্তর মেরুর কথা শুনব, এখন আমি ইস্কুলেই বরং যাই, মাথায় আমি লাল রুমাল কিছুতেই বাঁধতে পারব না।
লোকটা বলল: কে জানে ভুল করছ কি না?
আমি ততক্ষণ চায়ের দোকানের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে ট্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। প্রথম যে ট্রাম এল তাতেই উঠে পড়লাম। উঠেই ভীষণ চমকে গেলাম। দেখলাম ট্রামের কোনায় ডানদিকের সিটে আমার বইগুলো পড়ে রয়েছে। কেমন করে হল বুঝতে না পেরে ফুটপাথে চায়ের দোকানের সামনে কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকালাম।
আবার মনে হল তার মাথায় গাধার টুপির মতো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে রং-বেরঙের চড়াবড়া আঁকা, আর পায়ে শুড়োলা কালো জাদুকরের জুতো।
সে আমাকে হাত তুলে ইশারা করে চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। আর আমি মোড়ের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনও সাড়ে দশটাই বেজে রয়েছে।
টাকা চুরির খেলা
প্রথম যখন গণশার সঙ্গে আলাপ হল সে তখন সদ্য সদ্য নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস থেকে নেমেছে। চেহারাটা বেশ একটু ক্যাবলা প্যাটার্নের, হলদে বুট পরেছে–তার ফিতেয় আবার দু-জায়গায় গিট দেওয়া; খাকি হাফ প্যান্ট, আর গলাবন্ধ কালো কোট– তার একটাও বোম নেই, গোটা তিনেক বড়ো বড়ো মরচে-ধরা সেফটিপিন আঁটা। তার উপর মাথায় দিয়েছে সামনে বারান্ডওয়ালা হলদে কালো ডোরাকাটা টুপি। দেখে হেসে আর বাঁচিনে।
ছোটোকাকা সঙ্গে ছিল, গণশার দাদাকে ডেকে বলল, ওহে হরিচরণ, এটি আমার ভাইপো। তোমার ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে মিলবে ভালো। তাই শুনে গণশা রেগে কাই, অত ছোটো ভাই ছোটো ভাই করবেন না মশাই। আর ওই কুচো চিংড়িটার সঙ্গে মিলব ভালো, শুনলেও হাসি পায়।
ছোটোকাকার মুখের রংটা কীরকম পাটকিলে মতন হয়ে গেল। সেঁক গিলে বললেন বটে! সে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ! অথচ শেষ অবধি ওই গণশাকেই আমি বিষম ভক্তি করলুম।
সে এক মস্ত উপাখ্যান।
ছুটির দিন দুপুর বেলায় নিরিবিলি ছাদের ঘরের মেঝেতে বেশ আরাম করে উপুড় হয়ে শুয়ে, পা দুটোকে উঁচুবাগে তুলে একটা চেয়ারের পায়াতে লটকে, দিব্যি করে নিজের মনে দাদার টিকিটের অ্যালবামে নতুন নতুন পাঁচ পয়সার টিকিট সারি সারি মারছি, কারু কোনো অসুবিধা করছি না, কিছু না, এমন সময়ে ওরে গবা, গবা রে! বলে বাপরে সে কী চিল্লানো! আর এরা আমায় কিনা বলে যে গোলমাল করি! সেই বিকট গোলযোগ শুনে তাড়াতাড়ি টিকিট অ্যালবামটা লুকিয়ে ফেলে নীচে যেতে যাব, ভুলেই গেছি যে পা দুটো চেয়ারে লটকানো, তাড়াতাড়ি না টেনে নামাতে গিয়ে চেয়ার উলটে গেল, তার উপর দিদিটা হাঁদার মতন দুটো কাঁচের ফুলদানি রেখেছিল, সে তো গেল ভেঙে; সবচেয়ে খারাপ হল, আমার আধ-খাওয়া পেয়ারাটা ছিটকে গিয়ে ঘরের কোণে পিসিমার গঙ্গাজলের হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গেল।
এই সমস্ত ঘটনাতে আমার যে একেবারে কোনো দোষ ছিল না একথা যে শুনবে সেই বলবে। অথচ এই একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে দাদা, দিদি, পিসিমা এমন হইচই লাগাল, যেন তাদের ঘরে চোর সিঁদ কেটেছে! বাবা পর্যন্ত আমার দিকটা বুঝলেন না, বললেন–দোষ করে আবার কথা!
এরপর যখন ছোটোকাকা গোলমাল শুনে দাড়ি কামাতে কামাতে এসে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল– অনেক দিন থেকেই বলছি ও ঝুরিভাজা ছেলেকে বিদেয় কর। তা তো কেউ শুনলে না। এখন জেলখানাতেও ওকে নিতে রাজি হবেনা। সময় থাকতে নারানবাবুর ইস্কুলে দিয়ে দাও, নইলে নাকের জলে চোখের জলে এক হবে। মনে মনে বুঝলাম, ছোটোকাকার নতুন সাদা জুতোয় সেই যে কলম ঝাড়বার সময়ে সামান্য তিন-চার ফোঁটা কালি পড়েছিল, ছোটোকাকা এখনো সেকথা ভোলেনি।দিকগে বোর্ডিঙে, এদের চেয়ে খারাপ বোর্ডিঙে কেন নরকেও কেউ হতে পারে না। তাই রেগে, চেঁচিয়ে, হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগলাম–তাই দাওনা, তাই দাওনা, তাই দাওনা। এদিকে নিজে যখন বায়োস্কোপ দেখে দেরি করে ফিরে বাবার কাছে তাড়া খাও, তখন
বাবা বললেন– চোপ!
এরই ফলে ছুটির পর যখন ইস্কুল খুলল, আমি গেলুম নারানবাবুদের বোর্ডিঙে। বেশ জায়গা, বাড়ি থেকে ঢের ভালো। প্রথমটা সকাল বেলা হালুয়া খেতে বিশ্রী লাগত। তারপর দেখলাম ওতে খুব ভালো ঘুড়ি জুড়বার আঠা হয়। এ ছাড়া বোর্ডিঙের আর সব ভালো। গণশাও দেখলাম ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবে সে আমাদের ঘরে থাকে না।
প্রথম দিন শুতে গিয়ে দেখি আমাদের ঘরে ছ-জন ছেলে, পাঁচজন ছোটো আর একজন বড়ো। আমাদের ঘরের বড়ো ছেলেটি ঠিক বড়ো নয়, বরং মাঝারি সাইজের বললে চলে। কিন্তু তার তেজ কী! তার নাম পানুদা, তার কাজ নাকি আমাদের সামলানো, আর তাই করে করে নাকি তার ঠান্ডা মেজাজ খ্যাকখ্যাক করার ফলে দিন দিন বিগড়ে যাচ্ছে।