আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আর একটু আস্তে আস্তে বলল: জানো ভোররাতে বড়ো বড়ো চিংড়ি মাছ ধরতে হয়, তার এক-একটার ওজন এক সেরের বেশি। দু-দিন ধরে সমুদ্রের নীচে দড়ি-বাঁধা সব হাঁড়ার মতন ডুবিয়ে রাখতে হয়। আর ভোরবেলা গিয়ে ওই দড়ি ধরে টেনে হাঁড়াসুদ্ধ চিংড়ি তুলতে হয়। তারপর বাড়ি ফেরবার সময় আস্তে আস্তে সকাল হয়। তুমি তো জান যে পুব দিকে সূর্য ওঠে, কিন্তু একথা জান কি যে পশ্চিম দিকের আকাশটা আগে লাল হয়, তারপর পুব দিকে সূর্য ওঠে। তারও পর পশ্চিম দিকের লাল রং মিলিয়ে যায়, আর সমস্ত আকাশটা ফিকে পোড়া ছাইয়ের মতন হয়ে যায়। তারাগুলোকে নিবে যেতে কখনো দেখেছ কি?
আমার মনে হল আমার নিশ্চয় এখানে কিছু বলা উচিত কিন্তু আমার জিভ দেখলাম শুকিয়ে কাঠের মতন হয়ে গেছে। কিছু আর বলা হল না। খালি মনটা হু হু করতে লাগল। সে লোকটা আমার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে বলল: কীজন্য কলকাতায় পড়ে থাক আর ইস্কুলে যাও? জান রবিঠাকুর ইস্কুল পালিয়ে পালিয়ে অত বড়ো কবি হয়েছিলেন! আর জান, সাঁওতাল পরগনায় যখন মহুয়া গাছের ফল পাকে, তার গন্ধে জঙ্গলসুদ্ধ সব জিনিসে নেশা লেগে যায়। আর বনের ভাল্লুকগুলো মহুয়া খেয়ে খেয়ে নেশায় বেহুঁশ হয়ে গাছতলায় পড়ে থাকে। পরদিন সকালে কাঠুরেরা তাদের ওইরকমভাবে দেখতে পায়। তুমি জানতে যে মহুয়া ফল খেলে নেশায় ধরে? আমার তখন মনে হল দিনের-পর-দিন ইস্কুলে গিয়ে আমি বৃথাই জীবন নষ্ট করছি। ওই লোকটা নিশ্চয় কখনো ইস্কুলেই যায়নি।
হঠাৎ দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমার দিকে ফিরে অম্লানবদনে বলল, এসো৷ এমন করে বলল যেন বহুক্ষণ থেকে ওইরকমই কথা ছিল। ও-ও নামবে আর সেই সঙ্গে আমিও নামব।
আমি নামলাম। যদিও আমি জানতাম অচেনা লোক ডাকলে সঙ্গে যেতে নেই। যদিও দিনের-পর-দিন পিসিমা বলেছেন– দুষ্টু লোকেরা বলে: মন্ডা খাবি? সার্কাস দেখবি? এই সব বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে হয় আসামের চা বাগানে চালান দেয়, নয় ঘোর জঙ্গলে মা কালীর কাছে ঘ্যাচ করে বলি দেয়।
তবুও আমি নামলাম। কারণ রোজ রোজ ওই ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, পড়া তৈরি করা, স্নান করে ভাত খাওয়া, ইস্কুলে যাওয়া, ইস্কুল থেকে সারাটা দিনমান নষ্ট করে বিকেলে আবার বাড়ি ফেরা, সেই খাওয়া, সেই শোয়া– ওইরকম দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর বছর– যতদিন না অনিশ্চিত ভবিষ্যতে, কবে আমি বড়ো হয়ে ভালো চাকরি করে এইসব জিনিসের ভালো ফল দেখাব-ও আর আমার সহ্য হচ্ছিল না।
বইগুলো ট্রামের কোনায় আমার জায়গায় পড়ে রইল। আমি সেই লোকটার সঙ্গে গেলাম।
তখন মোড়ের ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজেছে।
সে আমাকে একটা চায়ের দোকানের ভিতর দিয়ে পিছন দিকের ছোটো একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে একটা টিনের চেয়ারে বসিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। একটু পরেই সে আবার ফিরে এল, সঙ্গে একটা একচোখা লোক, অন্য চোখটার গায়ে একটা সবুজ তাপ্পি মারা। একটা পা আছে, আরেকটা পা কাঠের তৈরি।
এই লোকটা আমার দিকে একচোখ দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল: কী হে ছোঁকরা, পড়াশুনোর উপর নাকি এমনই ঘেন্না ধরে গেছে যে একেবারে সেসব ত্যাগ করে এসেছ? তার গলাটা এমন কর্কশ আর চেহারাটাও এমন বিশ্রী যে আমি সত্যি ভারি ভড়কে গেলাম।
কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকাতেই সে গ্রামোফোনের চাকতির মতো বলে যেতে লাগল– পড়াশুনো করে কী হবে? জান, আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে যেসব বিরাট বিরাট নদী আছে তার ধারে ধারে কুমিরেরা আর হিপ্পোপটেমাসরা শুয়ে শুয়ে দিন কাটায় আর লম্বা লাল ঠ্যাঙে ভর দিয়ে গোলাপি রঙের ফ্ল্যামিংগো পাখিরা রোদ পোয়ায়? আর ওইসব জঙ্গলের মধ্যে এমন বিশাল বিশাল অর্কিড জাতের ফুল ফোটে যে তার মধ্যে একটা মানুষ দিব্যি আরামে শুয়ে থাকতে পারে?
বুঝতে পারছিলাম এ লোকটা জাদু জানে। কারণ তক্ষুনি আমার ভয়টয় কোথায় উড়ে গেল– অন্য লোকটাকে জোর গলায় বললাম: হাঁ, সেসব চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এসেছি। লোকটা হাসল, বলল: চিরদিন বড়ো দীর্ঘকাল হে ছোঁকরা চিরদিনের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু তোমার সাহস আছে, উৎসাহ আছে, তুমি অনেক কিছু করতে পারবে। স্বাস্থ্যটাও তো ভালো দেখছি। আশা করি বাড়ির জন্য মনের টান ইত্যাদি কোনো দুর্বলতা নেই?
হঠাৎ মনে হল মা এতক্ষণে স্নানের জোগাড় করছেন, বাবা আপিস গেছেন, এবং দু-জনেই মনে ভাবছেন আমি বুঝি ইস্কুলে গেছি। গলার কাছটা সবে একটু ব্যথা করতে শুরু করেছিল এমন সময় কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: ইস্কুলের বাইরে, বাড়ির বাইরে, কলকাতা থেকে বহুদূরে নরওয়ের উত্তরে চাঁদনি রাতে হারপুন দিয়ে তিমি শিকার হয়। তিমির গায়ে হারপুন বিঁধলে তিমি এমনি ল্যাজ আছড়ায় যে সমুদ্র তোলপাড় হয়ে যায়। কত নৌকো ডুবে যায়। আবার তিমি মরে গিয়ে যখন উলটে গিয়ে ভেসে ওঠে দেখবে তার বুকের রঙটা পিঠের চেয়ে ফিকে। আর, জান, ইংল্যান্ডে শীত কালে সোয়ালো পাখিরা থাকে না। তারা দলে দলে উড়ে স্পেনে চলে যায়, আর যেই শীত কমে আসে আবার তারা দলে দলে সমুদ্রের উপর দিয়ে অবিশ্রান্ত গতিতে উড়ে ফিরে আসে। এসে দেখে তাদের আগেই শীতের বাতাসকে তুচ্ছ করে ড্যাফোডিল ফুলরা ফুটে গেছে।