মনে করতে পারি যে এ-পারস্পারিকতা নারীর মুক্তিকে সহজতর করতে পারতো। হারকিউলিস যখন ওমফালের পায়ের কাছে বসে তাকে সাহায্য করেছিলো সুতো কাটায়, তখন তাকে বন্দী করে রেখেছিলো ওমফালের জন্যে তার কামনা; কিন্তু ওমফালে কোনো অর্জন করতে পারে নি স্থায়ী ক্ষমতা? জেসনের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে মিডিয়া হত্যা করেছিলো তাদের সন্তানদের; এ-নির্মম উপকথাটি নির্দেশ করে যে সন্তানদের প্রতি জেসনের ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মিডিয়া জেসনের ওপর বিস্তার করেছিলো এক ভয়াবহ প্রভাব। লাইসিসট্রাটায় আরিস্তোফানেস প্রমোদের সাথে এঁকেছেন একদল নারীর চিত্র, যারা পুরুষদের কাম পরিতৃপ্তির মধ্য দিয়ে লাভ করতে চায় সামাজিক সুবিধা; তবে এটা নাটমাত্র। সেদিন নারীদের উপকথায় দেখা যায় ধর্ষণকারীদের শাস্তি দেয়ার জন্যে তারা বন্ধ্যা থাকার যে-পরিকল্পনা করেছিলো, তারা তা ত্যাগ করে অনতিবিলম্বে। যৌন কামনা ও সন্তান লাভের বাসনার পরিতৃপ্তির জন্যে পুরুষ নির্ভরশীল হয় নারীর ওপর, কিন্তু সত্য হচ্ছে যে পুরুষের প্রয়োজন মিটিয়ে নারী কখনো সামাজিক মুক্তি লাভ করে নি।
প্রভু ও দাস সম্পর্কিত হয় পারস্পরিক প্রয়োজনে; এ-ক্ষেত্রে প্রয়োজনটা। আর্থনীতিক, এবং এটা দাসকে মুক্ত করে না। প্রভুর সঙ্গে দাসের যে-সম্পর্ক, তাতে প্রভু গুরুত্বই দেয় না যে দাস তার প্রয়োজন, কেননা নিজের কাজ দিয়েই নিজের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা তার আছে; অন্য দিকে দাস থাকে অধীন অবস্থায়, আশায় ও ভয়ে, এবং সব সময়ই সচেতন থাকে যে তার প্রভু প্রয়োজন। যদিও প্রয়োজনটা দুজনেরই, তবু এটা সব সময় কাজ করে উৎপীড়কের পক্ষে ও উৎপীড়িতের বিপক্ষে। এজন্যেই শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তিতে বিলম্ব ঘটেছে।
পুরুষের দাসী না হলেও নারী সব সময়ই আশ্রিত থেকেছে পুরুষের; এ-দুটি লিঙ্গ কখনো পৃথিবীকে সমভাবে ভোগ করে নি। নারী আজো ভীষণভাবে প্রতিবন্ধকতাগ্রস্ত, যদিও বদলাতে শুরু করেছে তার পরিস্থিতি। কোনোখানেই তার আইনগত মর্যাদা পুরুষের সমান নয়, এবং অধিকাংশ সময়ই এটা তার জন্যে অসুবিধাজনক। যদিও কখনো তার অধিকার আইনগতভাবে স্বীকার করে নেয়াও হয়, তবু দীর্ঘকালের প্রথার ফলে তার বাস্তবায়ন ঘটে না। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ দুটি জাতের মতো; অন্য সব কিছু সমান থাকলেও পুরুষ পায় ভালো চাকুরি, বেশি বেতন, এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে তাদের সাফল্যের সুযোগও বেশি। শিল্পকারখানা ও রাজনীতিতে পুরুষ পায় অনেক বেশি পদ, তারাই দখল করে নেয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো। এ ছাড়াও তারা উপভোগ করে প্রথাগত মর্যাদা, কেননা বর্তমান পবিত্রভাবে রক্ষা করে অতীতকে–এবং অতীতে পুরুষেরাই সৃষ্টি করেছে সব ইতিহাস। এখন নারীরা পৃথিবীর কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে শুরু করেছে, তবে পৃথিবী এখনো পুরুষের অধিকারে–এ-সম্পর্কে পুরুষ সন্দেহহীন এবং নারীদেরও সন্দেহ সামান্য। অপর হওয়া প্রত্যাখ্যান করা, এ-লেনদেনে অংশীদার হতে অস্বীকার করা–নারীর জন্যে এটা হবে উচ্চবর্ণের সাথে মৈত্রী তাদের যে-সব সুবিধা দিয়েছে, সে-সব পরিত্যাগ করা। সার্বভৌম পুরুষ অধীন নারীকে দেয় আর্থিক নিরাপত্তা এবং প্রতিপাদন করে তার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা। এটা সত্য যে প্রতিটি ব্যক্তি যেমন প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তার ব্যক্তিগত অস্তিত্ব, তেমনি নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে বস্তু হয়ে ওঠার প্রলোভনও কাজ করে তার মধ্যে। এটা এক অশুভ পথ, কেননা এ পথ যে ধরে–অক্রিয়, বিলুপ্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত সে–সে এর পর হয়ে ওঠে অন্যের ইচ্ছের প্রাণী। তবে এটা সহজ পথ; এ-পথ ধরলে খাঁটি অস্তিত্ব লাভের যন্ত্রণাগুলো থাকে না। নিজের সুস্পষ্ট শক্তির অভাবেই নারী কর্তার ভূমিকা লাভের দাবি জানাতে ব্যর্থ হয়, কেননা পুরুষের সাথে বন্ধনটাকেই সে চায়, পারস্পরিকতা চায় না, এবং অপর হিশেবে নিজের ভূমিকা নিয়ে সে অধিকাংশ সময়ই থাকে তুষ্ট।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে : এসব শুরু হয়েছিলো কীভাবে? সহজেই চোখে পড়ে যে লিঙ্গের দ্বৈততা, যে-কোনো দ্বৈততার মতোই, সৃষ্টি করে বিরোধ। এবং এতে যে জয়ী হয়, সে-ই ধারণ করে চরম মর্যাদা। কিন্তু পুরুষ কেননা প্রথম থেকেই জয়ী? এটা সম্ভবপর মনে হয় যে নারী হয়তো জয়ী হতে পারতো; বা ওই বিরোধের পরিণতি হতে পারতো ফলাফলহীন। এটা কীভাবে হলো যে পৃথিবী সব সময়ই থেকেছে পুরুষের অধিকারে এবং পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে এই সম্প্রতি? এ-পরিবর্তন কি ভালো জিনিশ? এর ফলে কি পুরুষ ও নারী পৃথিবীকে পাবে সমানভাবে?
প্রশ্নগুলো নতুন নয়, এবং এগুলোর উত্তর মাঝেমাঝেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু নারী যেহেতু অপর, তাই পুরুষেরা যে-সব উত্তর দিয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়। এসব উত্তর দেয়া হয়েছে সুস্পষ্টভাবে পুরুষের স্বার্থ থেকে। সতেরো শতকের একজন স্বল্পপরিচিত নারীবাদী, পলাঁ দ্য লা বার, এটা প্রকাশ করেছেন এভাবে : ‘পুরুষেরা নারী সম্পর্কে যা কিছু লিখেছে, তার সবই সন্দেহজনক, কেননা পুরুষ একই সঙ্গে বিচারক ও বিবাদী।’ সবখানে, সব সময়, পুরুষেরা এটা বোধ ক’রে সন্তোষ প্রদর্শন করেছে যে তারাই সৃষ্টির প্রভু। সমস্ত প্রশংসা বিধাতার… যিনি আমাকে নারী করে সৃষ্টি করেন নি,’ ইহুদিরা প্রাতকালীন প্রার্থনায় একথা বলে, যখন তাদের স্ত্রীরা প্রতিবাদহীন স্বরে বলে : সমস্ত প্রশংসা বিধাতার, যিনি আমাকে তাঁর অভিলাষ অনুসারে সৃষ্টি করেছেন। যে-সব আশীর্বাদ লাভের জন্যে প্লাতো দেবতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে যে তাকে মুক্ত মানুষ হিশেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, দাস হিশেবে নয়; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাকে পুরুষরূপে সৃষ্টি করা। হয়েছে, নারীরূপে নয়। তবে পুরুষের পক্ষে এ-সুবিধা পরিপূর্ণরূপে উপভোগ করা সম্ভব হতো না যদি না তারা বিশ্বাস করত যে এটা প্রতিষ্ঠিত পরম ও শাশ্বত ভিত্তির ওপর; তারা চেষ্টা করেছে তাদের প্রাধান্যকে অধিকাররূপে প্রতিষ্ঠিত করার। যারা আইন প্রণয়ন ও সংকলন করেছেন, তাঁরা পুরুষ ছিলেন, তাই তারা সুবিধা দিয়েছেন নিজেদের লিঙ্গকে, এবং বিচারকেরা এ-আইনগুলোকে উন্নীত করেছেন নীতির স্তরে, এটা পলাঁ দ্য লা বার থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি।