বিভিন্ন ধরনের আদিম সমাজ সম্পর্কিত এক জ্ঞানগর্ভ রচনার শেষে লেভি-স্ট্রাউস পৌঁচেছেন নিম্নরূপ উপসংহারে : প্রকৃত অবস্থা থেকে সংস্কৃত অবস্থায় যাত্রা চিহ্নিত হয়ে থাকে মানুষের বিশেষ সামর্থ দিয়ে যা জৈবিক সম্পর্কগুলোকে একগুচ্ছ বৈপরীত্যের পরম্পরারূপে দেখতে পায়; দ্বৈততা, পর্যায়ক্রম, বৈপরীত্য, এবং প্রতিসাম্য, সুস্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবএতো বেশি প্রপঞ্চ সৃষ্টি করে না, যাকে সমাজবাস্তবতার মৌল ও জরুরি উপাত্ত বলে ব্যাখ্যা করতে হবে। মানব সমাজ যদি হতো কোনো মিটজাইন বা সংহতি ও বন্ধুত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সাহচর্য, তাহলে এসব প্রপঞ্চ হতো অবোধগম্য। সব কিছু সহজ হয়ে ওঠে যদি আমরা হেগেলকে অনুসরণ করে দেখি যে চেতনার নিজের ভেতরেই রয়েছে অন্য সব চেতনার বিরুদ্ধে বিরোধিতা; বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় কর্তা–সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অপরিহার্যরূপে, যার বিপক্ষে আছে অপর, অপ্রয়োজনীয়, কর্ম।
তবে অপর চেতনা, অপর অহং, জ্ঞাপন করে একটি পারস্পরিক দাবি। এক দেশের অধিবাসী পাশের দেশে গিয়েই আহত বোধ করে যে ওই দেশের অধিবাসীদের কাছে সে গণ্য হচ্ছে আগন্তুক’ বলে। আসলে বিভিন্ন গোত্র, জাতি, ও শ্ৰেণীর মধ্যে যুদ্ধ, উৎসব, ব্যবসা, চুক্তি ও প্রতিযোগিতার প্রবণতা হচ্ছে অপর-এর ধ্রুব তাৎপর্য থেকে তাকে বঞ্চিত করা, এবং তার আপেক্ষিকতাকে সুস্পষ্ট করে তোলা; ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় ব্যক্তি ও দলকে বাধ্য করা হয় তাদের সম্পর্কের পারস্পরিকতা স্বীকার করে নিতে। তাহলে এটা কী করে ঘটলো যে দু-লিঙ্গের পারস্পরিক স্বীকৃত হলো না, বৈপরীত্যসূচক একটি ধারণাই হয়ে উঠলো অপরিহার্য, এর সাথে সম্পর্কিত ধারণাটিকে অস্বীকার করা হলো, এবং অন্য ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করা হলো বিশুদ্ধ অপর রূপে? এটা কেননা হলো যে নারী বিরোধিতা করে না পুরুষের সার্বভৌমত্বের? কোনো কর্তাই স্বেচ্ছায় হতে চায় না কম, অপ্রয়োজনীয়; অপর কখনো নিজেকে অপর রূপে সংজ্ঞায়িত করে এককে প্রতিষ্ঠিত করে না। একই অপরকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে নিজেকে এক রূপে সংজ্ঞায়িত করার জন্যে। অপর যদি নিজের এক হওয়ার মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে না পারে, তখন তাকে অনুগত হয়ে মেনে নিতে হয় বিরোধীর দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর ক্ষেত্রে এ-আনুগত্য কেমন করে ঘটলো?
এমন আরো অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে বিশেষ কোনো একটি ধারণা অন্য ধারণার ওপর কিছু সময়ের জন্যে আধিপত্য করতে পেরেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা ঘটে সংখ্যার অসমতার জনে–সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের শাসন চাপিয়ে দেয়। সংখ্যালঘুদের ওপর, বা চালায় অত্যাচার। কিন্তু নারীরা মার্কিন নিগ্রো বা ইহুদিদের মতো সংখ্যালঘু নয়; পৃথিবীতে যতো পুরুষ আছে নারীও আছে ততোই। আবার, দুটি গোত্র শুরুতে ছিলো স্বাধীন; তারা হয়তো জানতোও না একে অপরের কথা, বা হয়তো তারা স্বীকার করে নিতে পরস্পরের স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ফলে শক্তিমানরা পরাভূত করে দুর্বলদের। ইহুদিদের ছড়িয়ে পড়া, আমেরিকায় দাসত্বপ্রথা প্রবর্তন, সাম্রাজ্যবাদের দিগ্বিজয় এর উদাহরণ। এসব ক্ষেত্রে নির্যাতিতরা অন্তত তাদের স্মৃতিতে বহন করেছে আগের দিনের কথা; সম্মিলিতভাবে তারা ধারণ করেছে এক অতীত, এক ঐতিহ্য, কখনো এক ধর্ম বা এক সংস্কৃতি।
বেবেল নারী ও সর্বহারার মধ্যে যে-সাদৃশ্য দেখিয়েছেন, তা এখানে ঠিক যে এরা কখনোই কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠি বা মানবমণ্ডলির মধ্যে একটি স্বতন্ত্র যৌথ একক গঠন করে নি। সর্বহারারা চিরকাল ছিল না, তবে নারী সব সময়ই ছিলো। নারীরা তাদের দেহসংস্থান ও শারীরবৃত্ত অনুসারেই নারী। ইতিহাস ভরেই নারীরা ছিলো পুরুষের অধীন, তাই তাদের অধীনতা কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ফল নয় বা তা কোনো সামাজিক বদল নয়–এটা এমন কোনো ব্যাপার নয় যা সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ সময়ে কোনো অবস্থা ঘটানো হলে অন্য কোনো সময়ে তা বিলুপ্ত করা সম্ভব, যা প্রমাণ করেছে হাইতির নিগ্রোরা ও অন্যরা; তবে এটা মনে হতে পারে যে কোনো প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। সত্য হচ্ছে কোনো কিছুর প্রকৃতিই চিরন্তন নয়। যদি অপ্রয়োজনীয় মনে হয় নারীকে, যে কখনো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে না, এটা এজন্যে যে নারী নিজেই পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ। সর্বহারারা বলে আমরা’; নিগ্রোরাও বলে। নিজেদের কর্তা বিবেচনা করে তারা বুর্জোয়াদের, শাদাদের রূপান্তরিত করে অপর’-এ। কিন্তু নারীবাদীদের কিছু সম্মেলন বা এ-ধরনের কিছু বিক্ষোভে ছাড়া। নারীরা বলে না আমরা; পুরুষেরা বলে নারীরা’, আর নারীরাও নিজেদের নির্দেশ করার জন্যে ব্যবহার করে এ-একই শব্দ। তারা কখনো অকৃত্রিমভাবে কর্তার মনোভাব গ্রহণ করে না। সর্বহারারা রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছে, হাইতিতে ঘটিয়েছে নিগ্রোরা, ইন্দো-চীনে এর জন্যে সংগ্রাম করছে ইন্দো-চীনারা; কিন্তু নারীরা কখনো প্রতীকী বিক্ষোভের বেশি কিছু করে নি। তারা তা-ই লাভ করেছে, যা পুরুষ তাদের দিতে চেয়েছে; তারা কিছুই নেয় নি, তারা শুধু পেয়েছে।
এর কারণ হচ্ছে নারীদের এমন কোনো বাস্তব সম্বল নেই, যার সাহায্যে তারা নিজেদের সংগঠিত করতে পারে একটি এককে, যা পারে তাদের সাথে সম্পর্কিত এককটির মুখোমুখি দাঁড়াতে। তাদের নিজেদের কোনো অতীত নেই, ইতিহাস নেই, ধর্ম নেই; এবং সর্বহারাদের মতো তাদের নেই কোনো কর্ম ও স্বার্থের সংহতি। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে পুরুষদের মধ্যে; বাসগৃহ, গৃহস্থালি, আর্থিক অবস্থা, ও সামাজিক মর্যাদার সূত্রে তারা দৃঢ়ভাবে জড়িত থাকে কোনো পুরুষের সঙ্গে পিতা বা স্বামীর সঙ্গে–যা তারা থাকে না কোনো নারীর সঙ্গে। যদি তারা বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত হয়, তাহলে তারা ওই শ্রেণীর পুরুষের সাথে সংহতি বোধ করে, সর্বহারা নারীর সাথে করে না; যদি তারা শাদা হয়, তাহলে তারা শাদা শ্রেণীর পুরুষের সাথে সংহতি বোধ করে, নিগ্রো নারীর সাথে করে না। সর্বহারারা শাসকশ্রেণীকে হত্যা করার প্রস্তাব করতে পারে; এবং উগ্র কোনো ইহুদি বা নিগ্রো স্বপ্ন দেখতে পারে যে তার হাতে এসেছে আণবিক বোমা, এবং মানবমণ্ডলিকে সে ক’রে তুলেছে ইহুদি বা নিগ্রো; কিন্তু নারী পুরুষনিধনযজ্ঞের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। যে-বন্ধন তাকে বেঁধে রাখে। তার পীড়নকারীর সাথে, অন্য কিছুর সাথে তার তুলনা হয় না। লিঙ্গ বিভাজন একটি জৈবিক সত্য, এটা মানব ইতিহাসের কোনো ঘটনা নয়। নারী ও পুরুষ এক আদিম মিটজাইন-এ (সাহচর্য, সহবসবাস) পরস্পরের বিপরীতে বিন্যস্ত; নারী এটাকে ভাঙে নি। যুগল হচ্ছে এক মৌল ঐক্য, যার দু-অর্ধেককে একত্রে গেঁথে দেয়া হয়েছে, এবং লিঙ্গের রেখা ধরে সমাজে ফাটল ধরানো অসম্ভব। এখানেই পাওয়া যাবে নারীর মৌল বৈশিষ্ট্য : নারী অপর এমন এক সমগ্রতায়, যার দুটি উপাদান পরস্পরের কাছে প্রয়োজনীয়।