যদি নারী হিশেবে কাজ কয়া নারীর সংজ্ঞা তৈরির জন্যে যথেষ্ট না হয়, যদি আমরা তাকে ‘চিরন্তন নারীত্ব’ ধারণা দিয়েও ব্যাখ্যা করতে অস্বীকার করি, এবং যদি আমরা, আপাতত, স্বীকার করে নিই যে নারীরা আছে, তাহলে আমাদের একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হয় : নারী কী?
প্রশ্নটি করাই, আমার কাছে, একটি প্রাথমিক উত্তর নির্দেশ করা। আমি যে এপ্রশ্নটি করছি, এটাই তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো পুরুষই কখনো পুরুষ মানুষের উৎকট পরিস্থিতি সম্পর্কে একখানা বই লিখতে উদ্যত হবে না; কিন্তু আমি যদি নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাই, সবার আগে আমাকে বলতে হবে : ‘আমি একজন নারী’; পরবর্তী সমস্ত আলোচনা রচিত হবে এ-সত্যের ওপর ভিত্তি ক’রে। পুরুষ কখনোই নিজেকে কোনো এক বিশেষ লিঙ্গের সদস্য হিশেবে উপস্থাপিত করে শুরু করে না; সে যে পুরুষ, এটা বলা বাহুল্য। পুরুষ ও নারী শব্দ দুটি প্রতিসমরূপে ব্যবহৃত হয় শুধু গঠন হিশেবেই, যেমন আইনের কাগজপত্রে। বাস্তবে এ-দু-লিঙ্গের সম্পর্ক দুটি বৈদ্যুতিক মেরুর সম্পর্কের মতো নয়, কেননা পুরুষ ধনাত্মক ও নিরপেক্ষ উভয়ই নির্দেশ করে, যা দেখা যায় ম্যান শব্দটির সাধারণ ব্যবহারে, এটা বোঝায় সমগ্র মানবমগুলি; আর সেখানে নারী নির্দেশ করে শুধুই নেতিবাচকতা। কোনো বিমূর্ত আলোচনার মাঝে পুরুষদের মুখে শোনা যায় এমন বিরক্তিকর কথা; তুমি নারী ব’লেই এমন কথা ভাবছো; কিন্তু আমি জানি আত্মরক্ষার জন্যে আমার একমাত্র উত্তর হচ্ছে : “এটা সত্য ব’লেই আমি একথা ভাবছি, এটা বলে আলোচনা থেকে আমি সরিয়ে নিই আমার মন্ময় সত্তাকে। এমন উত্তর দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না যে : “তুমি পুরুষ বলেই উল্টোটা ভাবছে, তার কারণ পুরুষ হওয়া কোনো অস্বাভাবিকতা নয়। পুরুষ পুরুষ ব’লেই ঠিক; নারী হওয়াই অঠিক। এটা অনেকটা এমন : প্রাচীনদের কাছে ধ্রুব উল্লম্ব ব’লে একটা ব্যাপার ছিলো, যার সাথে তুলনা করে তারা নির্দেশ করতো তির্যককে, ঠিক তেমনি রয়েছে এক ধ্রুব মনুষ্যশ্রেণী, পুরুষ; নারীর রয়েছে ডিম্বাশয়, জরায়ু; এ-অস্বাভাবিকতাগুলো তাকে বন্দী ক’রে রাখে তার মন্ময়তার মধ্যে, আবদ্ধ রাখে তাকে তার নিজের স্বভাবের সীমার মধ্যে। মাঝেমাঝেই বলা হয় যে নারী চিন্তা করে তার লালাগ্রন্থির সাহায্যে। পুরুষ চমৎকারভাবে ভুলে যায় যে তাঁর দেহসংস্থানেও রয়েছে লালাগ্রন্থি, যেমন অন্ডকোষ; এবং এগুলো থেকে নিঃসৃত হয় হরমোন। সে নিজের শরীরের কথা ভাবে পৃথিবীর সাথে এক প্রত্যক্ষ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক পাতিয়ে রেখে, এবং মনে করে যে এটা সে অনুধাবন করছে বস্তুগতভাবে, আর সে নারীর শরীরকে মনে করে একটি প্রতিবন্ধকতা, একটি কারাগায়। ‘নারী বিশেষ কিছু গুণাবলির অভাবেই নারী, বৰ্লেছে আরিস্ততল, “আমরা মনে করবো যে নারীপ্ৰকৃতি প্রাকৃতিকভাবেই ত্রুটিগ্ৰস্ত।” সেইন্ট টমাস ঘোষণা করেছেন নারী হচ্ছে ‘বিকৃত পুরুষ’, একটি ‘অ্যাকস্মিক সত্তা’। এটাই প্রতীকিত হয়েছে হয়েছে আদিপুস্তক’-এ, বোসোর মতে যেখানে হাওয়াকে সমৃষ্টি করা হয়েছে আদমের একটি সংখ্যাতিরিক্ত অস্থি’ থেকে।
এভাবে মানবজাতি হচ্ছে পুরুষ এবং পুরুষেরা নারীকে নারী হিশেবে সংজ্ঞায়িত করে না, করে পুরুষের সাথে তুলনা করে; নারীকে গণ্য করা হয় না কোনো স্বায়ত্তশাসিত সত্তা রূপে। মিশেলে লিখেছেন : নারী, আপেক্ষিক সত্তা…।” রাপোর দ্য’ইউরিয়েল-এ বেন্দা লিখেছেন : ‘নারীর শরীরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও পুরুষের শরীর নিজেই অর্থ প্রকাশ করে, অন্যদিকে নারীর শরীর একলা নিজে তাৎপর্যহীন… পুরুষ নারীকে বাদ দিয়েও ভাবতে পারে নিজের কথা। নারী পুরুষ ছাড়া নিজের সম্পর্কে ভাবতে পারে না। নারী তা-ই, পুরুষ যা ঘোষণা করে; এজন্যেই তাকে বলা হয়। শুধু ‘লিঙ্গ’, যা দিয়ে বোঝানো হয় যে নারী পুরুষের কাছে শুধুই একটি লৈঙ্গিক প্রাণী; পুরুষের কাছে নারী লিঙ্গ, চরম লিঙ্গ, তার কম নয়। পুরুষের সাথে তুলনা ক’রে তাকে সংজ্ঞায়িত ও পৃথক করা হয়, নারীর সাথে তুলনা ক’রে পুরুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। নারী হচ্ছে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, যেখানে পুরুষ হচ্ছে প্রয়োজনীয়। পুরুষ হচ্ছে কর্তা, পুরুষ হচ্ছে পরম- নারী হচ্ছে অপর।
অপর ধারণাটি চেতনার মতোই একটি আদিম ধারণা। আদিমতম সমাজে, প্রাচীনতম পুরাণে পাওয়া যায় এক ধরনের দ্বৈততা- আত্ম ও অপরের দ্বৈততা। এ দ্বৈততা শুরুতে দু-লিঙ্গের বিভাজনের সাথে জড়িত ছিলো না; এটা নির্ভরশীল ছিলো না কোনো বাস্তব সত্যের ওপরও। গ্ৰানেতের চৈনিক চিন্তাধারা ও দিউমেজিলের পূর্ব ভারত ও রোম সম্পর্কিত রচনায় এটা দেখানো হয়েছে। শুভ ও অশুভ, সুলক্ষণ ও কুলক্ষণ, ডান ও বাম, বিধাতা ও লুসিফার প্রভৃতি বিপরীতাৰ্থক শব্দবন্ধে শুরুতে নারীউপাদান যতোটা ছিলো বরুণ-মিত্রা, ইউরেনাস-জিউস, সূৰ্য-চন্দ্র, এবং দিন-রাত্রি প্রভৃতি শব্দযুগলে নারী-উপাদান তার চেয়ে বেশি ছিলো না। মানুষের চিন্তাধারায় অপর একটি মৌল ধারণা।
কোনো গোত্রই কখনো নিজের বিপরীতে অপর ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত না করে নিজেকে এক বা আত্ম হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করে না। যদি তিনজন সহযাত্রী ট্রেনের এক কামরায় ওঠার সুযোগ পায়, এটাই কামরার অন্য যাত্রীদের বৈরী ‘অপর’-এ পরিণত করার জন্যে যথেষ্ট। সংকীর্ণদের চোখে নিজের গ্রামের অধিবাসী নয় এমন সব মানুষই ‘অপরিচিত’ ও সন্দেহজনক; এক দেশের মানুষের কাছে ভিন্ন দেশে বাস করে এমন সব মানুষই ‘বিদেশি’; ইহুদিবিরোধীদের কাছে ইহুদিরা ভিন্ন, মার্কিন বর্ণবাদীদের কাছে নিগ্রোরা নিকৃষ্ট, ঔপনিবেশিকদের কাছে ওই দেশের অধিবাসীরা ‘নেটিভ’, বিশেষাধিকারভোগীদের কাছে সর্বহারারা নিম্ন শ্রেণী।