হুমায়ূন আজাদ
৪ শ্রাবণ ১৪৩৮ : ১৯ জুলাই ২০০১
১৪ই ফুলার রোড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা।
ভূমিকা – দ্বিতীয় লিঙ্গ
নারী সম্পর্কে একটি বই লেখা নিয়ে আমি দীর্ঘকাল ধরে দ্বিধায় ছিলাম। বিষয়টি বিরক্তিকর, বিশেষ করে নারীদের কাছে; এবং এটা নতুন নয়। নারীবাদ নিয়ে কলহে প্রচুর কালির অপচয় হয়েছে, এবং এখন সম্ভবত এ নিয়ে আর কিছু না বলাই ভালো। তবে এখনো এ-সম্পর্কে কথা ওঠে, কেননা গত শতকে এ-সম্পর্কে বিপুল পরিমাণ বাজেকথা বলা হ’লেও তা সমস্যাটিকে একটুও আলোকিত করে নি। কোনো সমস্যা কি আছে আদৌ? যদি থাকে, সেটি কী? সত্যিই কি আছে আদৌ? যদি থাকে সেটা কি?সত্যিই কি আছে নারীরা? চিরন্তন নারীত্ত্বে বিশ্বাস করেন এমন লোক এখনো আছেন, যারা আপনার কানে ফিসফিস করে বলবেন; ‘এমনকি রাশিয়ায়ও নারীরা এখনো নারী’; এবং পন্ডিতজনেরা- কখনো কখনো একই ব্যক্তি- দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেনঃ ‘নারীরা তাঁর পথ হারিয়ে ফেলেছে, নারী বিলুপ্ত।’ কিন্তু যদি আজও থেকে থাকে নারী, যদি তারা থাকে চিরকাল, তারা থাকুক এটা বাঞ্চিত হোক বা না হোক, তাই ভাবতে ইচ্ছে করে পৃথিবীতে তারা অধিকার ক’রে থাকবে কোন স্থান, তাদের স্থান কি কোথাও হওয়া উচিত? একটি স্বল্পায়ু সাময়িকপত্র সম্প্রতি প্রশ্ন করেছে, ‘কী হয়েছে নারীদের?’
কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন করা দরকারঃ নারী কী? ‘তোতা মিউলিয়েন ইন ইউতেরো’ একজন বলেন, ‘ নারী হচ্ছে জরায়ু।’ তবে কোনো কোনো নারী সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে রসজ্ঞরা ঘোষণা করেন তারা নারী নয়, যদিও অন্য নারীদের মতা তারাও জরায়ুসম্বলিত। সবাই এ সত্যটি স্বীকার করে যে মানব প্ৰজাতির ভেতরে স্ত্রীলিঙ্গরা রয়েছে; চিরদিনের মতো আজো তারা মানবমগুলির অর্ধেক। তবুও আমাদের বলা হয় যে নারীত্ব বিপন্ন, আমাদের বিশেষভাবে উপদেশ দেয়া হয় নারী হতে, নারী থাকতে, নারী হয়ে উঠতে; তাই মনে হয় যে প্রতিটি স্ত্রীলিঙ্গ মানুষই নারী নয়; নারীরূপে বিবেচিত হতে হ’লে তার থাকতে হবে সে-রহস্যময় ও বিপন্ন বৈশিষ্ট্য, যাকে বলা হয় নারীত্ব। এটা কি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য, যা নিঃসৃত হয় ডিম্বাশয় থেকে? অথবা এটা কি কোনো প্লাতোয়ী সারবস্তু, কোনো দার্শনিক কল্পনার সামগ্রি? কোনো কোনো নারী এ-সারসত্তার প্রতিমূর্তি হওয়ার জন্যে ব্যগ্রভাবে চেষ্টা করলেও এর উৎপাদন অসম্ভব।
ধারণাবাদ তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারে নি। জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান আর স্বীকার করে না চিরস্থির অপরিবর্তনীয় গুণাবলির অস্তিত্ব, যা নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেগুলো চাপিয়ে দেয়া হয় নারী, ইহুদি, বা নিগ্রোদের ওপর। বিজ্ঞান কোনো বৈশিষ্ট্যকে আংশিকভাবে কোনো পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল বলে গণ্য করে। আজ যদি নারীত্ব না থাকে, তাহলে তা কখনো ছিলো না। তবে নারী শব্দটির কি কোনো বিশেষ অর্থ নেই? যাঁরা বিশ্বাস করেন যুক্তিবাদ ও নামবাদী দর্শনে, তাদের কাছে নারী হচ্ছে সে-সব মানুষ, যাদের স্বেচ্ছাচারীভাবে নির্দেশ করা হয় নারী শব্দটি দিয়ে। অনেক মার্কিন নাৱী মনে করে যে নারী বলে আর কিছু নেই; কোনো পিছিয়ে পড়া ব্যক্তি যদি নিজেকে নারী বলে মনে করে, তাহলে তার বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দেয় মনোসমীক্ষণের, যাতে সে এ-আবিষ্টতা থেকে মুক্ত করতে পারে নিজেকে। আধুনিক নারী : বিলুপ্ত লিঙ্গ নামে একটি বই সম্পর্কে ডরোথি পার্কার লিখেছেন : ‘যে- সব বই নারীকে নারী হিশেবে বিচার করে, সেগুলোর প্রতি আমি ন্যায়ানুগ হ’তে পারি না…. আমার ধারণা আমাদের সবাইকে, পুরুষ ও নারীদের, গণ্য করতে হবে মানুষ হিশেবে।” তবে নামবাদ একটি অসুষ্ঠ মতবাদ; আর নারীবাদবিরোধীদের এটা দেখিয়ে দিতে কোনোই কষ্ট হয় নি যে নারীরা পুরুষ নয়। নারী অবশ্যই, পুরুষের মতোই, একজন মানুষ; তবে এ-ঘোষণা বিমূর্ত। সত্য হচ্ছে প্রতিটি বাস্তব মানুষ সব সময়ই এক একলা, পৃথক সত্তা। চিরন্তন নারীত্ব, কৃষ্ণ আত্মা, ইহুদি চরিত্র ইত্যাদি ধারণা অস্বীকার করার অর্থ এই নয় যে আজ ইহুদি, নিগ্রো, ও নারীদের অস্তিত্ব নেই; এমন অস্বীকার এদের মুক্তি নির্দেশ করে না, নির্দেশ করে বাস্তবতা থেকে পলায়ন। কয়েক বছর আগে একজন বিখ্যাত নারী লেখক লেখিকাদের একগুচ্ছ ছবির মধ্যে তাঁর ছবি অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি দেন নি; তিনি চান পুরুষদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হ’তে। তবে এ সুবিধা পাওয়ার জন্যে তিনি খাটান তাঁর স্বামীর প্রভাব! যে-নারীরা নিজেদের পুরুষ ব’লে দাবি করে, তারা নির্ভর করে পুরুষদের বিবেচনা ও শ্রদ্ধাবোধের ওপরই। ট্রটস্কিপস্থি এক তরুণী, যে দাঁড়িয়েছিল এক হৈহুল্লাপূর্ণ এক জনসভার মঞ্চে, নিজের দেহের ভঙ্গুরতা সত্ত্বেও যে গুষোঘুষির জন্য ছিলো প্ৰস্তুত, তার কথা আমার মনে পড়ছে। সে অস্বীকার করেছিলো তাঁর নারীসুলভ দুর্বলতা; তবে সে এটা করেছিলো এক উগ্র পুরুষের প্রতি প্রেম থেকে, যার সমকক্ষ সে হ’তে চেয়েছিলো। অনেক মার্কিন নারীর স্পর্ধা প্রবণতা প্রমাণ করে যে তারা তাড়িত হচ্ছে তাদের নারীত্ববোধ দিয়ে। সত্য হচ্ছে, চোখ খোলা রেখে একটু ঘুরতে গিয়েই দেখা যায় মানবমণ্ডলি দু-শ্রেণীর মানুষে বিভক্ত, যাদের পোশাক, মুখমণ্ডল, শরীর, হাসি, হাঁটাচলার ভঙ্গি, আগ্রহ, এবং পেশা সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। সম্ভবত এসব ভিন্নতা বাহ্যিক, হয়তো এগুলো লোপ পেয়ে যাবে। তবে যা নিশ্চিত, তা হচ্ছে যে এসব সুস্পষ্টভাবে বিরাজমান।