১৭৯২-এ মেরি ওলস্টোনক্র্যাফুটের ভিডিকেশন-এর পর থেকে অনেকেই কাজ করেন, বাস্তবে ও তাত্ত্বিকভাবে, নারীমুক্তির জন্যে; গ’ড়ে তোলান একটি মৌলিক চিন্তাধারা, যাকে আজ বলা হয় নারীবাদ, তাঁর মধ্যে যেমন রয়েছেন রামমোহন রায়, লুসি স্টোন, কেড়ি স্ট্যান্টন, সুজান অ্যান্থনি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্টুয়ার্ট মিল, হেনরিক ইবসেন, বেগম রোকেয়া, হোসা লুক্সেমবার্গ, ভার্জিনিয়া উল্ফ, এবং আরো অনেকে, যারাঁ বাস্তবিক ও তাত্ত্বিকভাবে তৈরি করেন নারীমুক্তির আন্দোলন। বিশশতকে নারীবাদের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভোয়ার; তিনি যখন দ্বিতীয় লিঙ্গ লেখেন, তখন তিনি ছিলেন একা, তখন ভুলেই যাওয়া হয়েছিল নারীকে; তবে দু-দশকের মধ্যেই অন্ধকার কাটে, দেখা দেয় নারীবাদের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বা নবনারীবাদ, বেরোয় বেটি ফ্রাইডানের ফেমনিন মিস্টিক(১৯৬৩), কেইট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৬৯); দেখা দেন জারমেইন গ্রিয়ার, মেরি এলমান, সান্ড্রা গিলবার্ট, ফাতিমা মেরনিসসি, নওএল এল সাদাওয়ি, এলেন সিজো, ল্যুস ইরিগার, ক্রিস্তেভা, টাইগ্রেস অ্যাটকিন্সন, শুলামিথ ফায়ারস্টোন, শিলা রোওবোথাম এবং বিশ্ব জুড়ে আরো অজস্ৰ, যারা বদলে দেন পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার চরিত্র; এবং তঁরা কোনো-না-কোনোভাবে ঋণী সিমোন দ্য বোভোয়ারের কাছে। নারীবাদী আর কোনো পশ্চিমি প্রপঞ্চ নয়, এটা বিশ্বজনীন!
নারীবাদের বিশশতকের প্রধান প্রবক্তা, সিমোন দ্য বোভোয়ার কি ছিলেন। নারীবাদী? প্রশ্নটিই হাস্যকর মনে হ’তে পারে; এমন যে খ্রিস্ট কি ছিলেন খ্রিস্টান, মার্ক্স কি ছিলেন মার্ক্সবাদী? দ্য বোভোয়ার যখন, ১৯৪৯-এ, দ্বিতীয় লিঙ্গ লেখেন, তাঁর মনে হয়েছিলো সমাজতন্ত্রই নারীকে মুক্তি দেবে তাঁর দাসত্ব থেকে, তাই তখন তিনি নিজেকে মনে করেছেন একজন সমাজতন্ত্রবাদী, নারীবাদী নয়। কিন্তু এক সময় তাঁর ভুল ভাঙে, দেখতে পান সমাজতন্ত্র নারীকে মুক্তি দিচ্ছে না, ওটিও একটি পুংতন্ত্র। ১৯৭২-এ তিনি যোগ দেন ফ্রান্সের এমএলএফ-এ (নারীমুক্তি আন্দোলন), এবং প্ৰথমবারের মতো নিজেকে নারীবাদী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭০-এ এমএলএফ (নারীমুক্তি আন্দোলন) স্থাপিত হওয়ার আগে ফ্রান্সে যে-সব নারীসংঘ ছিলো, সেগুলো ছিলো সাধারণত সংস্কার ও আইনপস্থি। তাদের সাথে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার হয় নি। তুলনায় নবনারীবাদ আমূল্যবাদী। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষভাগে বলেছিলাম আমি নারীবাদী নই, কেননা আমি বিশ্বাস করতাম যে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের সাথে আপনা-আপনি সমাধান হয়ে যাবে নারীর সমস্যা। নারীবাদী বলতে আমি বোঝাতাম শ্রেণীসংগ্ৰামনিরপেক্ষভাবে বিশেষ নারীসমস্যা নিয়ে লড়াইকে। আমি আজো একই ধারণা পোষণ করি। আমার সংজ্ঞায় নারীবাদীরা এমন নারী- বা এমন পুরুষ- যারা, সংগ্ৰাম করছেন নারীর অবস্থা বদলের জন্যে, সাথে থাকছে শ্রেণীসংগ্রাম; এবং তঁরা শ্রেণীসংগ্ৰামনিরপেক্ষভাবেও, সমাজের সমস্ত বদলের ওপর নির্ভর না করে, নারীর অবস্থা বদলের জন্যে সংগ্ৰাম করতে পারেন। আমি বলবো, এ-অর্থেই আমি আজ নারীবাদী, কেননা আমি বুঝতে পেরেছি যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগে নারীর পরিস্থিতির জন্যে আমাদের লড়াই করতে হবে, এখানে এবং এখনই।’
সিমোন দ্যা বোভোয়ারের মৃত্যু হয় ১৪ আগস্ট, ১৯৮৬তে প্যারিসে; তখন তিনি হয়ে উঠেছিলেন নারীর সাম্য ও অধিকারের সংগ্রামের বিশ্বজনীন প্রতীক।
ল্য দ্যজিয়েম সেক্স : দ্বিতীয় লিঙ্গ বই কেমন? বলবো কি কি এটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ গদ্য বইগুলোর একটি; বলবো কি যদিও এ-দুটির মধেয় তুলনা চলে না, এটি ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর থেকেও উৎকৃষ্ট? কেনো বল্বো না? তলস্তয় পৌরাণিক অনেকাংশ ক্ষতিকর ও অতিমূল্যায়িত, আর দ্য বোভোয়ার ভবিষ্যতের। তত্ত্ব, দর্শন, ব্যাখ্যা প্রভৃতির কথা ছেড়ে দিলেও থাকে অনন্য শিল্পিতা, সৌন্দর্য, অজস্র উৎকৃষ্ট কবিতার রুপক, উপমা, চিত্রকর জড়ো হয়ে আছে এ-বইয়ে, এর বর্ণনাগুলোতে আছে এমন নিবিড়তা, যা ক্ষণে ক্ষণে মন এবং ইন্দ্রিয়গুলোকে দেয় পরম শিহরণ, যদিও মূল আমি পড়িনি। আমি অনুবাদ করেছি এইচ এম পার্শলির অসামান্য ইংরেজি অনুবাদটি থেকে, তবে পুরোটা অনুবাদ করি নি, তাহলে হাজার পাতায় পৌছোতে হতো; অনুবাদ করেছি আমার প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। আমি আন্তরিক থাকতে চেয়েছি পার্শলির প্রতি, যেমন তিনি চেয়েছেন। দ্য বোভোয়ারের প্রতি: কোথাও ভাবানুবাদ করি নি, মূলের মতোই উপস্থাপন করতে চেয়েছি বক্তব্য। অনুবাদে ভুগেছি নানা সমস্যায়, তার মধ্যে আছে পরিভাষা; তবে তা বড়ো নয়, ভঙ্গিটিই প্ৰধান সমস্যা। এবং সমস্যা সৰ্বনামের; ইংরেজিতে সর্বনামের পুং ও স্ত্রীলিঙ্গ রূপ রয়েছে, এবং রয়েছে বস্তু ও অবস্তুবাচক সর্বনাম, কিন্তু বাঙলা সর্বনাম লিঙ্গনিরপেক্ষ, এটা নারীবাদীদের কাছে সুখের হলেও অনুবাদকের জন্যে বড়োই অসুখের; হি’, ‘সি’র বিচিত্র রূপের, এবং ‘ইট’-এর কাজ শুধু ‘সে’ বা “তা’ দিয়ে কুলোনো যায় না; তাই অনেক সময় সর্বনামের বদলে বিশেষ্যই ব্যবহার করছি। পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে সংশোধন করা হলো অনেক কিছু, এবং বাড়লো একশো পাতার মতো; এবং আর বাড়বে না।