তবে সামন্তবাদ যখন শেষ হয়ে আসে, তখন নাইটসুলভ প্রেম নয়, ধর্ম নয়, কবিতাও নয়, অন্য কিছু কারণ কিছুটা প্রতিষ্ঠা দেয় নারীদের। রাজকীয় ক্ষমতা বাড়ার সাথে সামন্ত প্রভুরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে তাদের কর্তৃত্ব, হারিয়ে ফেলে তাদের ভৃত্যদের বিয়ে দেয়ার ক্ষমতা এবং তাদের সন্তানদের সম্পদ খরচের অধিকার। যখন থেকে ফিফ রাজাকে সামরিক সাহায্য দেয়ার বদলে অর্থ দিতে শুরু করে, তখন থেকে এটা হয়ে ওঠে নিছক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি সম্পত্তি, এবং দু-লিঙ্গকে সমভাবে না দেখার আর কোনো কারণ থাকে না। ফ্রান্সে কুমারী ও বিধবা নারীদের ছিলোপুরুষদের মতো সমস্ত অধিকার; ফিফের স্বত্বাধিকারী হিশেবে নারী বিচারকার্য করতো, চুক্তিতে স্বাক্ষর করতো, আইন জারি করতো। এমনকি সে সামরিক দায়িত্বও পালন করতো, পরিচালনা করতো সৈন্য ও যুদ্ধে অংশ নিতো : জোয়ান অফ আর্কের আগেও ছিলো নারী সৈনিক, এবং যদিও এ-তরুণী বিস্ময়জাগিয়েছিলো, সে কোনো কেলেঙ্কারি সৃষ্টি করে নি।
এতো সব ব্যাপার সম্মিলিত হয়েছিলো নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে ওগুলো একসাথে লোপ করা হয় নি। শারীরিক দুর্বলতা আর বিবেচনার বিষয়ছিলো না, তবে বিবাহিত নারীর অধীনতা সমাজের কাছে মঙ্গলজনক বলে মনে হয়। তাই সামন্তবাদ চলে যাওয়ার পরেও বৈবাহিক কর্তৃত্ব টিকে থাকে। দেখতে পাই একই অসঙ্গতি, যা টিকে আছে আজো : যে-নারী সমাজের সাথে সম্পূর্ণরূপে সংহত, তারই সুযোগসুবিধা সবচেয়ে কম। নাগরিক সামন্তবাদে বিয়ে তা-ই রয়ে যায়, যা ছিলো সামরিক সামন্তবাদে : স্বামী তখনও ছিলো স্ত্রীর অভিভাবক। যখন বুর্জোয়ারা দেখা দেয়, তারাও মেনে চলে একই আইন; মেয়ে ও বিধবার পুরুষের মতো একই অধিকার; কিন্তু বিয়ে হলেই নারী হয়ে ওঠে প্রতিপাল্য, যাকে পেটানো যায়, যার আচারব্যবহারের ওপর সারাক্ষণ চোখ রাখতে হবে, এবং যার টাকাপয়সা যথেচ্ছ ব্যয় করা যাবে। একলা নারীর দক্ষতা স্বীকার করা হয়েছে; তবে সামন্তবাদের কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত বিবাহিত নারীকে পরিকল্পিতভাবে বলি দেয়া হয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির কাছে। স্বামী যতো ধনী হতো স্ত্রী ততো বেশি নির্ভরশীল হতো স্বামীর ওপর; স্বামী নিজেকে যতো বেশি মনে করতো সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতাশীল, গৃহপতি হিশেবে সে হতো ততো বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ। অন্যদিকে, সাধারণ দারিদ্র্য দাম্পত্যবন্ধনকে করে তোলে পারস্পরিক বন্ধন। সামন্তবাদ নারীকে মুক্ত করে নি, ধর্মও করে নি। মধ্যযুগের উপাখ্যান ও উপকথাগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে শ্রমজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ও কৃষকদের এমন এক সমাজ, যাতে স্ত্রীকে পেটানোর শারীরিক জোর ছাড়া স্ত্রীর ওপর স্বামীর আর কোনো জোর ছিলো না; তবে স্ত্রীটি জোরের বিরুদ্ধে আশ্রয় নিতো ছলনার, এবং এভাবে দম্পতিটি বাস করতো সাম্যের মধ্যেই। তখন ধনী নারী তার আলস্যের মূল্য শোদধ করতো অধীনতা দিয়ে।
মধ্যযুগেও নারীর ছিলো কিছু সুযোগসুবিধা, কিন্তু ষোড়শ শতকে কিছু আইন করা হয়, যা টিকে থাকে প্রাচীন ব্যবস্থাব্যাপী; সামন্ত লোকাচার বিলুপ্ত হয়েছিলো এবং কিছুই আর চুলোর সাথে নারীকে বেঁধে রাখার পুরুষের বাসনা থেকে নারীকে রক্ষা করতে পারে নি। এ-বিধান নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করে ‘পুরুষসুলভ’ পদ, তাকে বঞ্চিত করে সমস্ত নাগরিক যোগ্যতা থেকে কুমারীকালে তাকে রাখে পিতার কর্তৃত্বে, পরে তার বিয়ে না হলে যে তারে পাঠিয়েদিতো সন্ন্যাসিনীদের মঠে, এবং আর যদি বিয়ে হতো, তাহলে তাকে ও তার সম্পত্তিকে ও তার সন্তানদের পুরোপুরি রাখতো স্বামীর কর্তৃত্বে। স্বামীকে দায়ীকরা হতো স্ত্রীর সমস্ত ঋণভার ও আচরণের জন্যে, এবং জনশাসনমূলক কর্তৃপক্ষ ও তার পরিবারের কাছে অপরিচিতদের সাথে তার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলো না। কাজে ও মাতৃত্বে সহযোগীর থেকে একটি দাসী বলেই তাকে মনে হতো : সে সৃষ্টি করতো যে-সব জিনিশ, মূল্য, মানুষ, সেগুলো তার সম্পদ হতো না, হতো পরিবারের, সুতরাং সে-পুরুষটির, যে ছিলো পরিবারের প্রধান। অন্যান্য দেশেও নারীর অবস্থা ভালো ছিলো না : তার কোনোরাজনীতিক অধিকার ছিলো না এবং লোকাচার ছিলো কঠোর। ইউরোপি সব আইনগত বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো গির্জীয় আইন, রোমীয় আইন, ও জর্মনীয় আইনের ভিত্তির ওপর–যার সবগুলোই ছিলো নারীবিরূপ। সব দেশেই ছিলো ব্যক্তিমালিকানা ও পরিবার এবং এগুলো চালানো হতো এসব সংস্থার দাবি অনুসারে।
এ-সব দেশেই পরিবারের কাছে সতীনারীদের দাসীত্বের অন্যতম ফল ছিলো বেশ্যাবৃত্তির অস্তিত্ব। ভণ্ডামোর সাথে সমাজের প্রান্তে লালিত বেশ্যারা সমাজে পালন করতো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। খ্রিস্টধর্ম এদের ওপর বর্ষণ করেছে প্রচণ্ড তিরস্কার, কিন্তু মেনে নিয়েছে এক অপরিহার্য অশুভ বলে। সেইন্ট অগাস্টিন ও সেইন্ট টমাস উভয়েই বলেছেন বেশ্যাবৃত্তি বিলোপের অর্থ নীতিভ্রষ্টতা দিয়ে সমাজকে বিপর্যস্ত করা : ‘প্রাসাদের কাছে পয়ঃপ্রণালি যেমন নগরের কাছে বেশ্যারা তেমন’। আদিমধ্যযুগে লোকাচার এতো লাম্পট্যপূর্ণ ছিলো যে বেশ্যাদের দরকারই পড়তো না; কিন্তু যখন প্রতিষ্ঠিত হয়বুর্জোয়া পরিবার এবং কঠোর একপতিপত্নীক বিয়ে নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়, তখন পুরুষদের প্রমোদ খুঁজতে হয় ঘরের বাইরে।