এসব আইন বর্বরদের অধিকৃত এলাকাগুলোতে সংস্পর্শে আসে জর্মনীয় প্রথার। শান্তিকালে জর্মনদের কোনো দলপতি থাকতো না, পরিবার ছিলোএক স্বাধীন সমাজ, যাতে নারীরা সম্পূর্ণভাবে ছিলো পুরুষের অধীন, তবে তাকে ভক্তি করা হতো, কিছু অধিকারও তার ছিলো। বিয়ে ছিলোএকপতিপত্নীক; এবং ব্যভিচারের শাস্তি ছিলো কঠোর। যুদ্ধকালে স্ত্রী স্বামীর সাথে যেতো যুদ্ধে, জীবনে ও মৃত্যুতে তার সাথে ভাগ্যের অংশী হয়ে, জানিয়েছেন তাসিতুস। নারীর নিকৃষ্টতার কারণ ছিলো তার দৈহিক দুর্বলতা, ওটি নৈতিক ছিলো না, এবং যেহেতু নারীরা ভূমিকা পালন করতো যাজিকার ও দৈবজ্ঞার, তাই তারা হয়তো ছিলো পুরুষদের থেকে শিক্ষিত।
এসব প্রথাই চলে মধ্যযুগে, নারী থাকে চূড়ান্তরূপে পিতা ও স্বামীনির্ভর। ফ্র্যাংকরা রক্ষা করতো না জর্মনীয় সতীত্ববোধ : বহুবিবাহের প্রচলন ছিলো; সম্মতি ছাড়া নারীকে বিয়ে দেয়া হতো; ছেড়ে দেয়া হতো স্বামীর খেয়ালখুশিতে; এবং তাকে গণ্য করা হতো চাকরানি বলে। আইন তাকে রক্ষা করতোজখম ও তিরষ্কার থেকে, তবে সেটা পুরুষের সম্পত্তি ও তার সন্তানদের মাতা হিশেবে। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন শক্তিশালী হয়ে ওঠে, একই বদল ঘটে যেমন ঘটেছেরোমে : অভিভাবকত্ব হয় রাষ্ট্রীয়, তা নিরাপত্তা দেয় নারীকে, তবে চলতে থাকে তার দাসীত্ব।
আদিমধ্যযুগের বিধ্বংসী উৎপ্লব থেকে যখন উদ্ভূত হয় সামন্তবাদ, নারীর অবস্থা হয়ে ওঠে অতিশয় অনিশ্চিত। সামন্তবাদ গোলমাল পাকিয়ে তোলে সার্বভৌমত্ব ও সম্পদের কর্তৃত্বের মধ্যে, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত অধিকার ও ক্ষমতার মধ্যে। এজন্যেই এ-ব্যবস্থায় একবার উন্নতি আবার অবনতি ঘটে নারীর অবস্থার। প্রথমে, নারীর ছিলো না কোনো ব্যক্তিগত অধিকার, যেহেতু তার ছিলো না রাজনীতিক ক্ষমতা; এর কারণ হচ্ছে একাদশ শতক পর্যন্ত সামাজিক বিন্যাস প্রতিষ্ঠিত ছিলো শুধু জোরের ওপর; ফিফ ছিলো সামরিক জোরে অধিকৃত ভূসম্পত্তি, যে-শক্তি নারীদের ছিলো না। পরে, পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকলে নারী উত্তরাধিকারী হতে পারতো; স্বামীই ছিলো ওই ফিফের রক্ষক ও অধিকারী, এবং আয়ের প্রাপক; নারী ছিল ওই ফিফেরই একটা অংশ।
সামন্তরাজ্য আর পারিবারিক ব্যাপার ছিলোনা; এর মালিক ছিলো সামন্তাধিপ, এবং সে ছিলো নারীরও মালিক। সামন্তাধিপ নারীর স্বামী ঠিক করতো, এবং তার সন্তানদের মালিক হতো, স্বামী মালিক হতো না, আর সন্তানদের নিয়তি হতো এই যে তারা হয়ে উঠতো সামন্তাধিপের দাস, যারা রক্ষা করতো তার ধনসম্পদ। তার ওপর একটি স্বামী চাপিয়ে দিয়ে তার নিরাপত্তা বিধানের জন্যে নারী হতো সামন্তরাজ্যের ও সামন্তরাজ্যের প্রভুর দাসী; খুব কম সময়ই এসেছে যখন নারীর ভাগ্য এর থেকে বেশি নির্মম ছিলো। উত্তরাধিকারিণী–এটা বোঝাতো ভূমি ও দুর্গ। বারো বা তার কম বয়সে তাকে বিয়েদেয়া হতো কোনো ব্যারনের সাথে। বেশি বিয়ে মানেই ছিলো বেশি সম্পত্তি, তাই ঘনঘন রদ হতো বিয়ে, গির্জা যা ভণ্ডামোর সাথে অনুমোদন করতো। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও দূরতম সম্পর্কিত দুজনের বিয়ের বিরুদ্ধে যে নিষেধ ছিলো, তাতে সহজেই পাওয়া যেতো বিয়ে রদের অজুহাত। একাদশ শতকের অনেক নারী এভাবে ত্যাজ্য হয়েছে চার পাঁচবার করে।
বিধবা হলে নারীর কাছে প্রত্যাশা হতো যে সে অবিলম্বে ধরবে একটি নতুন প্রভু। শাঁসোঁ দ্য জেস্ত-এ দেখতে পাই যে শার্লেমেন স্পেনে নিহত তার ব্যারনদের সব বিধবাকে দলবেঁধে বিয়ে করছে; এবং অনেক মহাকাব্যে পাওয়া যায় যে রাজা বা ব্যারন স্বেচ্চাচারিতার সাথে হস্তান্তরিত করে দিচ্ছে মেয়েদের ও বিধবাদের। স্ত্রীদের চুল ধরে টেনে পেটানো হতো, কঠোর শাস্তি দেয়া হতো। নাইটদের আকর্ষণ ছিলো না নারীর প্রতি; তাদের অশ্বকেই তাদের কাছে মনে হতো বেশি মূল্যবান। শাঁসোঁ দ্য জেস্ত-এ তরুণীরাই সব সময় প্রণয়ে উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তাদের কাছে চাওয়া হতো একপক্ষীয়একনিষ্ঠতা। কঠোর শারীরিক কাজের মধ্যে রূঢ়ভাবে লালনপালন করা হতো বালিকাদের, এবং দেয়া হতো না কোনো শিক্ষা। বড়ো হয়ে তারা শিকার করতো বন্যপশু, বিপজ্জনক তীর্থযাত্রা করতো, প্রভু রাজ্যের বাইরে থাকলে রক্ষা করতো ফিফ। এ-প্রভুপত্নীদের কেউ কেউ পুরুষদের মতোই হতো লোলুপ, দুরাচারী, নিষ্ঠুর, স্বেচ্ছাচারী; তাদের হিংস্রতার নানা ভয়াবহ গল্প ছড়িয়ে আছে। তবে এগুলো ব্যতিক্রম; সাধারণত প্রভুপত্নীরা জীবন কাটাতে চরকা কেটে, উপাসনা করে, পতির অপেক্ষায় থেকে, এবং অবসাদে মরে গিয়ে।
দ্বাদশ শতকে মিদিতে ‘নাইটসুলভ প্রেম’-এর আবির্ভাব হয়তো নারীর ভাগ্যকে একটু কোমল করে তুলেছিলো, এর উদ্ভব যেভাবেই হোক, প্রভুপত্নী ও তার তরুণ ভৃত্যের সম্পর্ক থেকেই হোক বা হোক কুমারীউপাসনা থেকে বা হোক সাধারণ ঈশ্বরপ্রীতি থেকে। ভদ্র প্রেমের ব্যাপারটি কখনো বাস্তবে ছিলো কি না সন্দেহ, তবে এটা নিশ্চিত যে গির্জা ত্রাতার মাতৃপুজোকে এমন এক স্তরে উন্নীত করেছিলো যে বলা যায় এয়োদশ শতকে ঈশ্বরকে পরিণত করা হয়েছিলো নারীতে। অভিজাত নারীদের স্বচ্ছল জীবনে সুযোগ আসে আলাপচারিতার, ভদ্ৰ আচরণের এবং ঘটে কবিতার বিকাশ। আকুইতেনের এলিনোর ও নাভারের ব্লাশের মতো বিদুষীরা পৃষ্ঠপোষকতা করেন কবিদের, এবং সংস্কৃতির বিপুল বিকাশ নারীদের দেয় এক নতুন মর্যাদা। নাইটসুলভ প্রেমকে অনেক সময় প্লাতোয়ী প্রেম বলে গণ্য করা হয়েছে; কিন্তু সত্য হচ্ছে সামন্ত স্বামীরা ছিলো কর্তৃত্বপরায়ণ ও স্বৈরাচারী, এবং স্ত্রীরা খুঁজতো পরকীয়প্রেমিক; নাইটসুলভ প্রেম ছিলো অপরিহার্য লোকাচারের বর্বরতার এক ধরনের ক্ষতিপূরণ। যেমন এঙ্গেলস বলেছেন, ‘প্রেম, শব্দটির আধুনিক অর্থে, উদ্ভূত হয়েছিলো প্রাচীন কালে প্রথাবদ্ধ সমাজের বাইরে। যৌন প্রেমের খোঁজে যেখানে থামে প্রাচীন কাল সেখানেই শুরু হয় মধ্যযুগ : ব্যভিচার’। যে-পর্যন্ত বিবাহপ্রথা টিকে থাকবে ততোদিন পর্যন্ত প্রেম ধরবে ওই রূপই।