ওই সময় পর্যন্ত লাতিন সাহিত্য সব সময়ই নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে, কিন্তু তার পর ব্যঙ্গলেখকেরা উঠে-পড়ে লাগে তাদের বিরুদ্ধে। আদি প্রজাতন্ত্রে রোমের নারীদের পৃথিবীতে একটা স্থান ছিলো, তবে বিমূর্ত অধিকার ও আর্থনীতিক মুক্তির অভাবে তারা শৃঙ্খলিত ছিলো; পতনের কালের রোমের নারীরা ছিলো ভ্রান্ত মুক্তির উৎপাদন, তাদের ছিলো শূন্যগর্ভ স্বাধীনতা এমন এক বিশ্বে, যেখানে পুরুষেরা ছিলো সর্বময় প্রভু : নারী মুক্ত ছিলো– কিন্তু অহেতুক।
মধ্যযুগব্যাপী থেকে আঠারো শতকের ফ্রান্স পর্যন্ত
প্রথম খণ্ড । ভাগ ২ – ইতিহাস । পরিচ্ছেদ ৪
নারীর অবস্থার বিবর্তন কোনো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ছিলো না। যখন ঘটতো বড় ধরনের বহিরাক্রমণ, তখন সন্দেহ দেখা দিতো সব সভ্যতা সম্বন্ধেই।রোমন আইন নিজেই পড়ে এক নতুন ভাবাদর্শের, খ্রিস্টধর্মের, প্রভাবে; এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে বর্বররা সফল হয় তাদের আইন চাপিয়ে দিতে। আর্থনীতিক, সামাজিক, ও রাজনীতিক পরিস্থিতিকে একেবারে উল্টে দেয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয় নারীর পরিস্থিতিতে।
খ্রিস্টীয় ভাবাদর্শ নারীপীড়নে কম ভূমিকা পালন করে নি। সন্দেহ নেই সুসমাচারে আছে একটু সদয়তার শ্বাস, যা প্রসারিত যেমন নারীদের প্রতি তেমনি কুষ্ঠরোগীদের প্রতিও; এবং সে-হীনজনেরাই, দাসেরা ও নারীরা, চরম সংরাগে আঁকড়ে ধরেছিলো এ-নতুন আইন। আদিখ্রিস্টীয় পর্বে নারীদের বেশ কিছুটা মর্যাদা দেয়া হতো, যখন তারা আত্মসমর্পণ করতো দাসত্বের কাছে; পুরুষের পাশাপাশি শহিদ হিশেবে তারাও সাক্ষ্য দিতো। কিছু উপাসনায় তারা নিতে পারতো শুধু গৌণ স্থান, ‘ডিকনিস’রা অধিকার পেতো শুধু রোগীর সেবা ও দরিদ্রদের সাহায্য করার মতো অযাজকীয় কাজের। আর বিয়েকে যদি ধরি এমন একটি প্রথা বলে যাতে দরকার পারস্পরিক বিশ্বস্ততা, তাহলে স্পষ্ট দেখা যায় যে স্ত্রীকে পুরোপুরি অধীন করা হয় স্বামীর : সেইন্ট পলের মাধ্যমে বর্বরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নারীবিদ্বেষী ইহুদি ঐতিহ্য।
সেইন্ট পল নারীদের আদেশ দেন আত্মবিলোপের ও সতর্কতার সাথে চলার; তিনি পুরোনো ও নতুন উভয় টেস্টামেন্ট অনুসারে নারীকে করেতোলেন পুরুষাধীন। ‘যেহেতু নারীর থেকে পুরুষ নয়; কিন্তু পুরুষের থেকে নারী। নারীর জন্যে পুরুষ সৃষ্টি হয় নি; কিন্তু নারী পুরুষের জন্যে’। এবং আরেক স্থানে : ‘কেননা স্বামী হচ্ছে স্ত্রীর মাথা, যেমন খ্রিস্ট হচ্ছে গির্জার মাথা… সুতরাং গির্জা যেমন খ্রিস্টের অধীনে, তেমনি নারীরা সব কিছুতে তাদের স্বামীদের অধীনে’। যে-ধর্মে দেহকে মনে করা হয় অভিশপ্ত, সেখানে নারীরা হয়ে ওঠে শয়তানের ভয়াবহতম প্রলোভন। তারতুলিয়ান লিখেছেন : ‘নারী, তুমি শয়তানের প্রবেশদ্বার। তুমি এমন একজনকে নষ্ট করেছো, যাকে শয়তানও সরাসরি আক্রমণ করার সাহস করতো না। তোমার জন্যেই ঈশ্বরের পুত্রকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে; তোমাকে সব সময় থাকতে হবে শোকে এবং ছিন্নবস্ত্রে’। সেইন্ট অ্যান্ড্রোস : ‘আদমকে পাপে প্রলুব্ধ করেছিলো হাওয়া এবং আদমপ্রলুব্ধ করে নি হাওয়াকে। এটা ন্যায়সঙ্গত ও ঠিক যে নারী তাকে মানবে প্রভু ও মালিক হিশেবে, যাকে সে পাপিষ্ঠ করেছিলো’। এবং সেইন্ট জন ক্রাইসোস্টম : ‘বন্যপশুদের মধ্যেও নারীদের মতো ক্ষতিকর কাউকে পাওয়া যায় না’। চতুর্থ শতকে যখন গির্জীয় আইন বিধিবদ্ধ হয়, বিয়েকে গণ্য করা হয় মানুষের নৈতিক দুর্বলতার প্রতি একটি স্বীকৃতিরূপে, যা খ্রিস্টীয় শুদ্ধতার সাথে অসমঞ্জস। ‘এসো আমরা হাতে তুলে নিই কুড়োল এবং বিয়ের নিষ্ফল গাছকে কেটে ফেলি গোড়া থেকে,’ লিখেছেন। সেইন্ট জেরোম। গ্রেগরি ৬-এর সময় থেকে, যখন পুরোহিতদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় কৌমার্যব্রত, অধিক প্রচণ্ডতার সাথে জোর দেয়া হতে থাকে নারীপ্রকৃতির ভয়ঙ্করতার ওপর : গির্জার সব পিতাই নিন্দা করেন নারীর হীনতাপূর্ণ অশুভ প্রকৃতির। সেইন্ট টমাস এ-ঐতিহ্যের প্রতিই ছিলেন বিশ্বস্ত, যখন তিনি ঘোষণা করেন যে নারী হচ্ছে শুধু এক ‘আকস্মিক’ ও অসম্পূর্ণ সত্তা, এক ধরনের অশুদ্ধ পুরুষ। ‘পুরুষ নারীর ওপরে, যেমন খ্রিস্ট মানুষের ওপরে,’ তিনি লিখেছেন। ‘এটা অপরিবর্তনীয় যে নারীর নিয়তিই হচ্ছে পুরুষের অধীনে বাস করা, এবং তার প্রভুর কাছে থেকে সে কোনো কর্তৃত্ব পায় নি’। তাছাড়া, গির্জীয় বিধি পণ ছাড়া নারীর জন্যে আর কোনো বৈবাহিক সুবিধার ব্যবস্থা করে নি, ফলে নারী হয়ে ওঠে আইনতভাবে অযোগ্য ও শক্তিহীন। পুরুষসুলভ পেশাগুলোই শুধু তার জন্যে বন্ধ হয়ে যায় না, এমনকি বিচারালয়ে তার সাক্ষ্য দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়, এবং তার প্রামাণিক সাক্ষ্যেরও কোনো গুরুত্ব থাকে না। গির্জার পিতাদের প্রভাব কিছুটা পড়েছিলো সম্রাটদের ওপরও। জাস্টিনিয়ানের বিধান নারীকে স্ত্রী ও মাতা হিশেবে মর্যাদা দেয়, কিন্তু তাকে এ-ভূমিকারই অধীন করে রাখে; লিঙ্গের জন্যে নয়, পরিবারের মধ্যে তার পরিস্থিতির জন্যেই নারী অর্জন করে আইনগত অযোগ্যতা। বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ হয় এবং বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে হয় প্রকাশ্যে। সন্তানদের ওপর মাতার কর্তৃত্ব পিতার সমানই থাকে; স্বামী মারা গেলে সে হয় সন্তানদের বৈধ অভিভাবক। সেনেটের ভেল্লিয়ীয় বিধি সংশোধন করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে নারী তৃতীয় পক্ষের মঙ্গলের জন্যে চুক্তি করতে পারে; তবে সে তার স্বামীর পক্ষে চুক্তি করতে পারতো না; তার পণ হয়ে ওঠে অচ্ছেদ্য–এটা হয় উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানদের প্রাপ্য বিষয়সম্পত্তি এবং তার জন্যে নিষিদ্ধ করা হয় এটা বিক্রি বা হস্তান্তরিত করা।