নারী পেয়েছিলো তার স্বাধীনতার একটি নিশ্চয়তাও; পিতা তাকে পণ দিতে বাধ্য ছিলো। বিয়ে ভেঙে গেলে এ-পণ তার পুরুষ আত্মীয়দের কাছে ফেরত যেতো না, এবং এটা তার স্বামীর অধিকারেও কখনো থাকতো না; নারীটি যে-কোনো সময় বিবাহচ্ছেদের মাধ্যমে এটা স্বামীর কাছে থেকে ফেরত চাইতে পারতো, ফলে তার কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা ছাড়া স্বামীর কোনো উপায় থাকতো না। প্লউতুসের মতে, ‘পণ গ্রহণ করে, সে বিক্রি করে দিয়েছে তার ক্ষমতা’। প্রজাতন্ত্রের সমাপ্তি থেকে মাতাও সন্তানদের কাছে পিতার সমান মর্যাদার অধিকারী হয়ে ওঠে; কর্তৃত্ব লাভ করে বা স্বামী যদি হতো দুরাচারী, সে পেতে সন্তানদের অধিকার। হাদ্রিয়ানের কালে সেনেটের একটি আইনে তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়। যদি তার তিনটি সন্তান থাকে এবং তাদের কেউ সন্তানহীন মারা যায়–যদি তারা মৃত্যুর আগে ইচ্ছেপত্র রেখে না যায়, তাহলে তাদের প্রত্যেকের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার সে পায়। মার্কুস অউরেলিউসের শাসনকালে রোমন পরিবারের বিবর্তন পূর্ণতা লাভ করে : ১৭৮ অব্দ থেকে, পুরুষ আত্মীয়দের ওপর জয়ী হয়ে, সন্তানেরা হয় তাদের মায়ের উত্তরাধিকারী; তারপর থেকে পরিবার গড়ে ওঠে কনইউঙ্কতিও সাঙ্গিউনিস-এর ভিত্তির ওপর; এবং মায়ের মর্যাদা হয় পিতার সমান; কন্যারা উত্তরাধিকারী হয় ভাইদের মতোই।
তবে ওপরে আমি যে-বর্ণনা দিয়েছি, তার বিরোধী একটি প্রবণতা দেখতে পাই রোমান আইনের ইতিহাসে; পরিবারের মধ্যে নারীদের স্বাধীন করেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাকে আবার নিয়ে নেয় নিজের কর্তৃত্বে; এটা তাকে আইনগত অধিকারহীন করে তোলে নানাভাবে।
এটা সত্য যদি নারী হয় ধনী ও স্বাধীন, তাহলে লাভ করে এক পীড়াদায়ক গুরুত্ব; তাই দরকার হয়ে পড়ে তার কাছে থেকে এক হাত দিয়ে তা ফিরিয়ে নেয়া, অন্য হাত দিয়ে তাকে যা দেয়া হয়েছে। যখন হানিবল হুমকি দিচ্ছিলো রোম আক্রমণের, তখন রোমের নারীদের বিলাসিতা নিষিদ্ধ করে গৃহীত হয় ওপ্পিয়ান আইন; বিপদ কেটে গেলে রোমেরা ওই আইন বাতিলের দাবি জানায়। এক বক্তৃতায় কাতো এটা রাখার দাবি করেন; কিন্তু ময়দানে মাতৃদের উপস্থিতিতে দিনটি যায় তাঁর বিপক্ষে। পরে কঠোরতর নানা আইন প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু তাতে তারা সফল হয় নি। এগুলো ধাপ্পাবাজির থেকে বেশি কিছু করতে পারে নি। শুধু বিজয়ী হয় সেনেটের ভেল্লেয়ীয় আইন, যাতে নারীদের নিষিদ্ধ করা হয় অন্যদের ‘মাধ্যস্থ করা’–অর্থাৎ অন্যদের সাথে চুক্তি করা নিষিদ্ধ করা হয়–যা তাকে বঞ্চিত করে প্রায় সব আইনসঙ্গত অধিকার থেকে। এভাবে যখন নারী লাভ করছিলো সম্পূর্ণ মুক্তি, তখনই দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করা হয় তার লৈঙ্গিক নিকৃষ্টতা, যাতে পাই পুরুষপ্রাধান্যের যৌক্তিকতা প্রতিপাদনের এক অসাধারণ উদাহরণ, যে সম্পর্কে আমি বলেছি : যখন কন্যা, স্ত্রী, বা বোন হিসেবে খর্ব করা হয় নি নারীর অধিকার, তখন লিঙ্গানুসারে অস্বীকার করা হয়পুরুষের সাথে তার সাম্য; প্রভুত্বমূলক দাম্ভিক রীতিতে অভিযুক্ত করা হয় ‘মূঢ়তা, লিঙ্গের দুর্বলতা’কে।
সত্য হচ্ছে যে মাতৃরা তাদের নতুন স্বাধীনতার বিশেষ সদ্ব্যবহার করতে পারে নি; তবে এও সত্য যে একে একটি সদর্থক ব্যাপারে পরিণত করার অধিকার তাদের দেয়া হয় নি। এ-দুটি বিরোধী প্রবণতার ফলাফল- একটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী প্রবণতা, যা নারীকে মুক্ত করে পরিবার থেকে এবং স্থিতিমূলক প্রবণতা, যা ব্যক্তি হিশেবে তার স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করে, তার পরিস্থিতিকে করে তোলে ভারসাম্যহীন। উত্তরাধিকারসূত্রে সে সম্পত্তি লাভ করতে পারতো, পিতার সাথে সন্তানদের ওপর তার ছিলো সমান অধিকার, সে সাক্ষ্য দিতে পারতো। পণপ্রথার কল্যাণে সে মুক্তি পেতো দাম্পত্য পীড়ন থেকে, নিজের ইচ্ছেয় সে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ করতে পারতো; তবে সে মুক্তি পেয়েছিলো শুধু নেতিবাচক রীতিতে, কেননা তার শক্তিকে প্রয়োগ করার মতো কোনো বাস্তব কাজ তাকে দেয়া হয় নি। আর্থনীতিক স্বাধীনতা থেকে যায় বিমূর্ত, কেননা এটা কোনো রাজনীতিক ক্ষমতা সৃষ্টি করে না। এভাবে এমন ঘটে যে, কর্ম করার সমান সামর্থ্যের অভাবে রোমের নারীরা শুধু বিক্ষোভ প্রদর্শন করে : তুমুল কোলাহলের মধ্যে জড়ো হয় তারা নগর ভরে, বিচারালয় অবরোধ করে, ষড়যন্ত্রের ইন্ধন জোগায়, প্রতিবাদ করে, গৃহযুদ্ধ বাঁধায়; শোভাযাত্রার সময় তারা খুঁজে বের করে দেবমাতার মূর্তি এবং টাইবারের তীর ধরে তাকে বহন করে, এভাবে তারা রোমে চালু করে প্রাচ্য দেবদেবীদের; ১১৪ অব্দে দেখা দেয় ভূষিত কুমারীদের কেলেঙ্কারি এবং তাদের সংঘকে নিষিদ্ধ করা হয়।
যখন পরিবারের বিলুপ্তি পারিবারিক জীবনের প্রাচীন গুণাবলিকে নিরর্থক করে তোলে ও বাতিল করে দেয়, তখন আর নারীর জন্যে থাকে না কোনো প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা, কেননা বাইরের জীবন ও তার নৈতিকতা তার কাছে রয়ে যায়অগম্য। নারীরা বেছে নিতে পারতো দুটি সমাধানের, একটি : তাদের পিতামহীদের মূল্যবোধকে একগুয়েভাবে শ্রদ্ধা করে যেতে পারতো বা কোনো মূল্যবোধকেই স্বীকার
না করতে পারতো। প্রথম শতকের শেষ দিকে ও দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে আমরা দেখতে পাই যে প্রজাতন্ত্রের কালে যেমন তারা ছিলো তাদের স্বামীদের সঙ্গী ও সহযোগী তেমনভাবেই জীবন চালাচ্ছে বহু নারী : প্লোতিনা অংশী ছিলেন ত্রাজানের গৌরব ও দায়িত্বের; সাবিনা তাঁর জনহিতকর কাজের সাহায্যে নিজেকে এতোটা বিখ্যাত করে তোলেন যে জীবেকালেই মূতিতে মূর্তিতে তাঁকে দেবীত্বে উন্নীত করা হয়; তাইবেরিউসের অধীনে আমির্লিউস স্কারুসের মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে অস্বীকার করেন সেক্সতিনা, এবং পোম্পোনিউস লাবিউসের মৃত্যুর পর পাস্কিয়া; সেনেকার সাথে নিজের রগ কেটে ফেলে পাউলিন; অনুজ প্লিনি বিখ্যাত করে তুলেছেন আরিয়ার ‘এতে ব্যথা লাগছে না পায়েতুস’কে; অনিন্দ্য স্ত্রী ও অনুরক্ত মাতা হিশেবে ক্লদিয়া রিউফিনা, ভার্জিনিয়া, ও সুলপিকিয়াকে প্রশংসা করেছেন মার্তিয়াল। তবে বহু নারী ছিলো, যারা মাতৃত্ব অস্বীকার করেছিলো এবং বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছিলো। আইন তখনও নিষিদ্ধ করেছে ব্যভিচারকে, তাই অনেক মাতৃ এতো দূর পর্যন্ত গিয়েছিলো যে তারা বেশ্যা হিশেবে তাদের নাম লিখিয়েছে, যাতে তারা চালিয়ে যেতে পারে তাদের ইন্দ্রিয়পরতন্ত্রতা।