এসব উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে, গ্রিসের নারীদের পরিণত করা হয়েছিলো আধাক্রীতদাসীতে, যাদের এমনকি অভিযোগ করার স্বাধীনতাও ছিলো না। ধ্রুপদী মহাযুগে নারীদের কঠোরভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হতো গাইনিকিউমে, নারীমহলে; পেরিক্লেস বলেছিলো সে-ই শ্রেষ্ঠ নারী, যার সম্পর্কে পুরুষেরা সবচেয়ে কম কথা বলে। প্লাতোরাষ্ট্রপরিচালনায় মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করার ও মেয়েদের মানবিক শিক্ষা দেয়ার প্রস্তাব দিলে আরিস্তোফানেস তীব্র গালিগালাজ করেন তাঁকে। তবে জেনোফোনের মতে স্বামী ও স্ত্রীরা ছিলো পরস্পরের অচেনা, এবং সাধারণত স্ত্রীদের হতে হতো সদাসজাগ গৃহিণী–সতর্ক, মিতব্যয়ী, মৌমাছির মতো পরিশ্রমী, এক আদর্শ তত্ত্বাবধায়ক। নারীদের এ-হীনাবস্থা সত্ত্বেও গ্রিকরা ছিলো প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী। প্রাচীন প্রবচনরচয়িতাদের থেকে ধ্রুপদী লেখকেরা পর্যন্ত, নারী ছিলোধারাবাহিক আক্রমণের বিষয়; তবে তারা চরিত্রহীনতার জন্যে আক্রান্ত হতো না। কেননা এদিকে প্রচন্ডভাবে নিয়ন্ত্রণে ছিলো নারী এবং আক্রান্ত হতো না তাদের কামক্ষুধার জন্যেও; বিয়ে যে-বোঝা ও ঝামেলা চাপিয়ে দেয় পুরুষদের ওপর, তারই জন্যে আক্রান্ত হতো নারীরা। দজ্জাল স্ত্রী ও বিবাহিত জীবনের দুঃখযন্ত্রণার বিরুদ্ধে গ্রিগ নাগরিকদের সমস্ত ক্ষোভ রূপায়িত হয়েছে জানতিপ্পির মধ্যে।
রোমে পরিবার ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধই নির্ধারণ করে দেয় নারীর ইতিহাস। এত্রুস্কান সমাজ ছিলো মাতৃধারার, এবং সম্ভবত রাজতন্ত্রের কালেও রোমে প্রচলিত ছিলো মাতৃধারা ব্যবস্থায় গোত্রবহির্ভুত বিবাহ : লাতিন রাজারা উত্তরাধিকারসূত্রে একে অন্যের হাতে ক্ষমতা দেয়নি। এটা নিশ্চিতভাবে ঠিক যে তারকুইনের মৃত্যুর পরই প্রতিষ্ঠিত হয়পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ব; কৃষিসম্পত্তি, ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি–সুতরাং পরিবার–হয় সমাজের ভিত্তির একক। নারীকে শক্তভাবে জড়িত করা হয় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তির সাথে এবং তাই পরিবারের বংশের সাথে। গ্রিক নারীদের যতোটুকু নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিলো, রোমের আইন সেটুকু থেকেও বঞ্চিত করে নারীদের; সে যাপন করে আইনগতভাবে সামর্থহীনের ও দাসত্বের জীবন। তাকে বাদ দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় ব্যাপার থেকে, তার জন্যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয় সমস্ত ‘পুরুষসুলভ’ পদ; এবং সামাজিক জীবনে সে হয় স্থায়ীভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাকে রাখা হয় একজন অভিভাবকের কর্তৃত্বে।
নারীর প্রথম অভিভাবক ছিলো তার পিতা; পিতার অনুপস্থিতিতে পুরুষ আত্মীয়রা পালন করতো এ-দায়িত্ব। যখন নারীর বিয়ে হতো, সে চলে যেতো স্বামীর হাতে; ছিলো তিন ধরনের বিয়ে : কনফেরাতিও, এতে দম্পতিটি ফ্লেমেন দায়ালিস-এর সামনে জুপিটারের বেদিমূলে উৎসর্গ করতো একটি আটার পিঠে; কোএম্পতিও, এটা ছিলো এক কাল্পনিক বিক্রয়, যাতে কৃষিজীবী পিতা স্বামীর কাছে বিক্রি করতো মেয়েকে; এবং উসুস, এটা ছিলো এক বছরব্যাপী সহবাসের ফল। এসবই ছিলো ‘মানু’, যার অর্থ হচ্ছে পিতা বা অন্য কোনো অভিভাবকের বদলে স্বামীর কর্তৃত্ব লাভ; স্ত্রী হয়ে উঠতো তার কোনো কন্যার মতোই, এবং এরপর স্ত্রীর দেহ ও সম্পত্তির ওপর স্বামীর থাকতো পূর্ণ অধিকার। কিন্তু যেহেতু রোমের নারীরা একই সাথে অন্তর্ভুক্ত ছিলো পিতার ও স্বামীর বংশে, তাই দ্বাদশ বিধি আইনের কাল থেকে দেখা দেয় বিরোধ, যা ছিলো তাদের আইনগত মুক্তির মূলে। আসলে মানু সম্বলিত বিয়ে নারীর পৈতৃক অভিভাবকদের সর্বস্বান্ত করে তোলে। পৈতৃক অভিভাবকদের রক্ষার জন্যে প্রবর্তিত হয় সিনে মানু নামে এক ধরনের বিয়ে; এতে নারীর সম্পত্তি থেকে যায় তার অভিভাবকের কর্তৃত্বে, স্বামী শুধু পায় নারীটির দেহের অধিকার। এমনকি এ-ক্ষমতাও স্বামীকে ভাগ করে নিতে হতো স্ত্রীর পিতার সাথে, যার ছিলো কন্যার ওপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। গার্হস্থ্য বিচারপরিষদকে ক্ষমতা দেয়াহয়েছিলো সে-সব বিবাদ মিটিয়ে দেয়ার, যেগুলোর ফলে স্বামী ও পিতার মধ্যে বিরোধ বাঁধতে পারতো; এ-বিচারপরিষদ স্ত্রীকে অনুমতি দিতো পিতার পক্ষ থেকে স্বামীর প্রতি বা স্বামীর পক্ষ থেকে পিতার প্রতি পুনর্বিচার প্রার্থনার; এবং নারী এদের কারো অস্থাবর সম্পত্তি ছিলো না। এছাড়াও, যদিও পরিবারসংস্থা ছিলো খুবই শক্তিশালী, পিতা ও গৃহস্বামী সবার কাছে সে গণ্য হতো নাগরিক বলে। তার কর্তৃত্ব ছিলো অসীম, সে ছিলো স্ত্রী ও সন্তানদের নিরঙ্কুশ শাসক; তবে এরা তার সম্পত্তি ছিলো না; বরং সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্যে সে নিয়ন্ত্রণ করতো তাদের জীবন। স্ত্রী, যে পৃথিবীতে আনতো সন্তান এবং যার গৃহস্থালির কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো খামারের কাজ, সে ছিলো দেশের জন্যে অত্যন্ত মঙ্গলজনক এবং তাকে ভক্তি করা হতো গভীরভাবে।
এখানে আমরা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সত্য লক্ষ্য করি, যার মুখোমুখি হবো আমরা ইতিহাসের ধারাব্যাপী : বিমূর্ত অধিকার নারীর বাস্তব পরিস্থিতি নির্দেশের জন্যে যথেষ্ট নয়; এটা বড়ো অংশে নির্ভর করে তার অর্থনীতিক ভূমিকার ওপর; এবং অনেক সময় বিমূর্ত অধিকার ও বাস্তুব ক্ষমতার ভিন্নতা ঘটে ব্যস্তানুপাতিকভাবে। আইনে গ্রিক নারীদের থেকে বেশি দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে রোমের নারীরা অনেক বেশি গভীরভাবে অঙ্গীভূত ছিলোসমাজের সাথে। গাইনিকিউমে গুপ্ত থাকার বদলে গৃহে সে বসতো বসতবাড়ির কেন্দ্রস্থলে; সে দাসদের কাজ পরিচালনা করতো; সে সন্তানদের শিক্ষা দেখাশুনো করতো, এবং বিশেষ বয়স পর্যন্ত তাদের প্রভাবিত করতো। সে স্বামীর সঙ্গে ভাগ করে নিতো শ্রম, তাকে গণ্য করা হতো সম্পত্তির সহমালিক। স্যাবাইন নারী লুক্ৰেতিয়া ও ভার্জিনিয়ার মতো কিংবদন্তি থেকে বোঝা যায় নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো ইতিহাসে; কোরিওলানাস আত্মসমর্পণ করেছিলো তার মা ও স্ত্রীর অনুনয়ের কাছে; রোমান গণতন্ত্রের বিজয় অনুমোদন করে লুকিনিয়াসের আইন তৈরি হয়েছিলো তার স্ত্রীর প্রেরণায়। ‘সর্বত্র পুরুষেরা শাসন করে নারীদের ওপর’, বলেছিলেন কাতো, ‘আর আমরা যারা শাসন করি সব মানুষকে, তারাই শাসিত হই আমাদের নারীদের দিয়ে’।