যেহেতু নারীপীড়নের কারণ নিহিত পরিবারকে স্থায়িত্ব দেয়ার ও উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি অখণ্ড রাখার বাসনার মধ্যে, তাই নারী পরিবার থেকে যতোখানি মুক্তি পায় ততোখানি মুক্তি পায় পরাধীনতা থেকে; যদি কোনোসমাজ ব্যক্তিমালিকানা নিষিদ্ধ করার সাথে পরিবার প্রথাও অস্বীকার করে, তাহলে তাতে নারীর ভাগ্য বেশ উন্নত হতে বাধ্য। স্পার্টায় প্রচলিত ছিলো সংঘব্যবস্থা এবং এটাই ছিলো একমাত্র গ্রিক নগর, যেখানে নারীর অবস্থা ছিলো প্রায়পুরুষের অবস্থার সমান। মেয়েদের লালনপালন করা হতো ছেলেদের মতো; স্ত্রী তার ঘরে বন্দী থাকতো না; আর স্বামী স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারতো চুপিসারে, রাতের বেলা; এবং স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার এতো কম ছিলো যে সুসন্তান জন্মানোর প্রয়োজনে অন্য যে-কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে মিলনের দাবি করতে পারতো। যখন উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি লোপ পায়, তখন ব্যভিচারের ধারণাও লোপ পায়; সব সন্তানের মালিক হয় নগর; আর নারীদের তখন উৎসাহের সঙ্গে এক প্রভুর দাসী করে রাখা হয় না; বা, উল্টোভাবে, বলা যায় নাগরিকদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বিশেষ পূর্বপুরুষ না থাকায় তাদের মালিকানায় কোনো নারীও থাকে না। নারীদের ভোগ করতে হয়েছে মাতৃত্বের দাসত্বশৃঙ্খল, যেমন পুরুষদের ভোগ করতে হয়েছে যুদ্ধের দাসত্বশৃঙ্খল; তবে এ-নাগরিক দায়িত্ব পূরণের বাইরে তাদের স্বাধীনতার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় নি।
যে-মুক্ত নারীদের কথা বলা হলো, তাদের ও পরিবারের দাসীদের পাশাপাশি গ্রিসে ছিলো বেশ্যারাও। প্রাচীন মানুষেরা অতিথিবৎসল বেশ্যাবৃত্তিও পালন করতো—অচেনা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো নারী দিয়ে, নিঃসন্দেহে এর ছিলো অতীন্দ্রিয় যৌক্তিকতা–এবং ছিলো ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি, যার লক্ষ্য ছিলো উর্বরতার রহস্যময় শক্তি সবার মঙ্গলের জন্যে অবারিত করে দেয়া। প্রথাটি প্রচলিত ছিলো ধ্রুপদী মহাযুগে। হিরোদোতাস বর্ণনা করেছেন যে খ্রিপূ পঞ্চম শতকে ব্যাবিলনের প্রতিটি নারী বাধ্য ছিলো জীবনে একবার মুদ্রার বিনিময়ে মাইলিত্তার মন্দিরে কোনো অচেনা পুরুষের কাছে দেহদানে, যে-অর্থ সে দান করতো মন্দিরে; তারপর সে ঘরে ফিরে যেতো সতীজীবন যাপনের জন্যে। আধুনিক কালেও ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি প্রচলিত ছিলো মিশরের নর্তকীদের মধ্যে ও ভারতের বাঈজিদের মধ্যে, যারা ছিলো সম্ভ্রান্ত অভিজাত গায়িকা ও নর্তকী। তবে সাধারণত মিশরে, ভারতে, পশ্চিম এশিয়ায় ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি পরিণত হয় বৈধ ভাড়াটে বেশ্যাবৃত্তিতে, কেননা যাজকতন্ত্র দেখতে পায় যে ব্যবসাটা বেশ লাভজনক। এমনকি হিব্রুদের মধ্যেও ভাড়াটে বেশ্যাবৃত্তি প্রচলিত ছিলো।
গ্রিসে, বিশেষ করে সমুদ্র-উপকূল ধরে, দ্বীপগুলোতে, ও ভ্রমণকারীতে পরিপূর্ণ নগরগুলোতে, ছিলো অনেক মন্দির, যেখানে পাওয়া যেতো পিন্ডারের ভাষায় ‘আগন্তুকদের প্রতি আতিথ্যপরায়ণ যুবতীদের’। তাদের উপার্জিত অর্থ যেতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে–অর্থাৎ, পুরোহিতদের কাছে ও পরোক্ষভাবে তাদের ব্যয়নির্বাহের জন্যে। বাস্তবে ছিলো–কোরিন্থ ও অন্যান্য স্থানে নাবিকদের ও ভ্রমণকারীদের কামক্ষুধা মেটানোর ভণ্ডামো, এবং এটা পরিণত হয়েছিলো অর্থগৃধ্নু বা ভাড়াটে বেশ্যাবৃত্তিতে। সোলোন একে পরিণত করে বেশ্যাবৃত্তির প্রতিষ্ঠানে। সে এশীয় ক্রীতদাসী কিনতে থাকে এবং তাদের আটকে রাখে অ্যাথেন্সে অবস্থিত ভেনাসের মন্দিরের কাছাকাছি ‘সংকেতস্থল’-এ, যেগুলো বন্দর থেকে বেশি দূরে ছিলো না এর পরিচালনার ভার ছিলো পর্নোত্রোপোই-এর হাতে, যারা পালন করতো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিচালনার দায়িত্ব। প্রতিটি মেয়ে মজুরি পেতো, আর শুদ্ধ লাভটুকু যেতো রাষ্ট্রের কোষে। পরে খোলা হয় ব্যক্তিমালিকানাধীন বেশ্যালয়, কাপেইলিম্বা, যাতে একটি লাল উল্কি ব্যবহৃত হতো ব্যবসার চিহ্ন হিসেবে। অনতিপরেই ক্রীতদাসী ছাড়াও নিম্ন শ্রেণীর গ্রিক নারীদেরও গ্রহণ করা হয় সেখাকার বাসিন্দা হিশেবে। ওই ‘সংকেতস্থল’গুলোকে এতো আবশ্যক গণ্য করা হয় যে সেগুলো স্বীকৃতি পায় শরণলাভের অলঙ্ঘনীয় স্থান বলে। তবে বেশ্যারা ছিলো মর্যাদাহীন, তাদের কোনোসামাজিক অধিকার ছিলো না, তাদের সন্তানদের অব্যাহতি দেয়া হতো তাদের ভরণপোষণ থেকে, তাদের পরতে হতোনানা রঙের একটি বিশেষ পোশাক, সাজতে হতো কুসুমস্তবকে, এবং কুঙ্কুম দিয়ে চুল রাঙাতে হতো।
ওই ‘সংকেতস্থল’-এর নারীরা ছাড়াও ছিলো স্বাধীন বারবনিতারা, যাদের ফেলা যায় তিনটি শ্রেণীতে। পতিতারা, যারা ছিলো আজকের অনুমতিপ্রাপ্ত বেশ্যাদের মতো; বাঈজিরা, যারা ছিলো নর্তকী ও বংশীবাদক; এবং অভিজাত গণিকারা, বিলাসিনী নারীরা, যাদের অধিকাংশই আসতো কোরিন্থ থেকে, যারা গ্রিসের সুবিখ্যাত পুরুষদের সাথে গড়েতুলতো স্বীকৃত সম্পর্ক, পালন করতো আধুনিক কালের ‘বিশ্বরমণীর’ মতো ভূমিকা। প্রথম শ্রেণীটি সংগৃহীত হতো মুক্তিপ্রাপ্ত নারীদের ও নিম্ন শ্রেণীর গ্রিক মেয়েদের মধ্য থেকে; তারা শোষিত হতো দালালদের দ্বারা এবং যাপন করতোদুর্বিষহ জীবন। দ্বিতীয় শ্রেণীটি গায়িকা হিসেবে প্রতিভার জন্যে কখনো কখনো ধনাঢ্য হয়ে উঠতো; এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত লামিয়া, যে ছিলো মিশরের এক টলেমির উপপত্নী, পরে যে হয় টলেমিকে পরাস্তকারী মেসিদনিয়ার রাজা দিমিত্রিয়াস পোলিওরকেতেসের উপপত্নী। তৃতীয় ও শেষ শ্ৰেণীটির অনেকে গৌরব অর্জন করেছে তাদের প্রেমিকদের সাথে। নিজেদের ও তাদের ভাগ্যকে স্বাধীনভাবে চালানোর অধিকারী ছিলো তারা, ছিলো বুদ্ধিমান, সুসংস্কৃত, কলানিপুণ; তাদের সঙ্গদানের মোহিনীশক্তিতে মুগ্ধ ছিলো যারা, তাদের কাছে তারা গণ্য হতো ব্যক্তিরূপে। তারা যেহেতু মুক্তি পেয়েছিলো পরিবার থেকে এবং বাস করতো সমাজের প্রান্তিক এলাকায়, তারা মুক্তি পেয়েছিলো পুরুষ থেকেও; তাই পুরুষদের কাছে তারা গণ্য হতো সহচর, প্রায় সমতুল্য, মানুষ হিসেবে। আস্পাসিয়া, ফ্রাইনে, লায়াসের মধ্যে রূপ লাভ করেছিলো পরিবারের শ্রদ্ধেয় মাতার ওপর স্বাধীন নারীর শ্রেষ্ঠত্ব।