ছিলো তিন ধরনের বিয়ের চুক্তি : একটি ছিলো দাসীত্বমূলক বিয়ে; নারীটি হতে পুরুষটির সম্পত্তি, তবে অনেক সময় নির্দেশিত থাকতো যে পুরুষটির আর কোনো উপপত্নী থাকবে না; একই সময়ে বৈধ স্ত্রীকে গণ্য করা হতোপুরুষটির সমান, এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তিতে ছিলো তাদের সমান অধিকার; প্রায়ই বিবাহবিচ্ছেদের সময় স্বামীটি স্ত্রীকে কিছু অর্থ দিতে সম্মত হতো। এ-প্রথা থেকে পরে উদ্ভূত হয় এক ধরনের চুক্তি, যা বিশেষভাবে সুবিধাজনক ছিলোস্ত্রীটির জন্যে : স্বামীটি স্ত্রীটির ওপর পোষণ করতো এক কৃত্রিম আস্থা। ব্যভিচারের দণ্ড ছিলো কঠোর, কিন্তু উভয়পক্ষেরই ছিলো বিবাহবিচ্ছেদের স্বাধীনতা। এসব চুক্তি প্রয়োগ প্রবলভাবে হ্রাস করে বহুবিবাহ; নারীরা সম্পদের ওপর একচেটে অধিকার ভোগ করে ও উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়ে যায় তাদের সন্তানদের, যার ফলে দেখা দেয় একটি ধনিকতান্ত্রিক শ্ৰেণী। টলেমি ফিলোপাতের আদেশ জারি করে যে নারীরা আর তাদের স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা ছাড়াসম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবে না, এটা তাদের পরিণত করে চিরঅপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষে। তবে এমনকি যখনও তাদের ছিলো একটি বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত মর্যাদা, প্রাচীন বিশ্বে যা ছিলো অনন্য, তখনও নারীরা সামাজিকভাবে পুরুষের সমতুল্য ছিলো না। ধর্মে ও শাসনকার্যে অংশী হয়ে তারা রাজপ্রতিভূ হিসেবে কাজ করতে পারতো, তবে ফারাও ছিলো পুরুষ; পুরোহিত ও সৈনিকেরা ছিলো পুরুষ; বাইরের কর্মকাণ্ডে তারা পালন করতো গৌণ ভূমিকা; এবং পারিবারিক জীবনে তাদের কাছে দাবি করা হতো পারস্পরিকতাহীন আনুগত্য।
গ্রিকদের রীতি ছিলো অনেকটা প্রাচ্যদেশের মতোই; তবে তাদের মধ্যে বহুবিবাহ ছিলো না। কিন্তু কেনো, তা অজ্ঞাত। এটা সত্য যে একটা হারেম রাখা সব সময়ই ব্যয়বহুল : এটা সম্ভব মহিমামণ্ডিত সলোমনের পক্ষে, আরব্যরজনীর সুলতানদের পক্ষে, সেনাপতি, ধনিকদের পক্ষে, যারা মত্ত হতে পারতো কোনো বিশাল হারেমের বিলাসব্যসনে; গড়পরতা মানুষ তিন-চারটি স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো; চাষীদের খুব কম সময়ই থাকতো দুটির বেশি স্ত্রী। এছাড়াও– মিশর বাদে, যেখানে কোনো বিশেষ ব্যক্তিমালিকানাধীন বিষয়সম্পত্তি ছিলো না–উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তিকে অখণ্ডিত রাখার জন্যে পৈতৃক সম্পত্তিতে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে দেয়া হয় বিশেষ অধিকার। এর ফলে স্ত্রীদের মধ্যে গড়ে ওঠে একটা স্তরক্রম, অন্যদের তুলনায় প্রধান উত্তরাধিকারীর মাতা লাভ করে বিশেষ মর্যাদা। যদি স্ত্রীর নিজের থাকতো কোনো সম্পত্তি, যদি সে পেতো কোনো পণ, তাহলে স্বামীর কাছে সে গণ্য হতো একজন ব্যক্তি হিশেবে : স্বামীটি স্ত্রীর সাথে জড়িত হতো এক ধর্মীয় ও একান্তু বন্ধনে।
সন্দেহ নেই এ-পরিস্থিতির ফলেই মাত্র একটি স্ত্রীকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রথা গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে গ্রিক নাগরিকেরা বাস্তবে ছিলো বহুবিবাহী, কেননা তারা তাদের কামনা চরিতার্থ করতে পারতো নগরের বেশ্যাদের সাথে এবং তাদের গাইনিকিউমের দাসীদের সাথে। ‘আত্মার সুখের জন্যে আমাদের আছে গণিকা,’ বলেছেন দিমোসথিনিস, ‘কামসুখের জন্যে আছে উপপত্নী, এবং পুত্রলাভের জন্যে আছে স্ত্রীরা।‘ স্ত্রী যখন রুগ্ন, অসুস্থ, গর্ভবতী, বা প্রসবের পর সেরে উঠতে থাকতো, তখন গৃহস্বামীর শয্যায় স্ত্রীর বদলে স্থান পেতো উপপত্নী; তাই গাইনিকিউম আর হারেমের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিলো না। অ্যাথেন্সে স্ত্রী বন্দী থাকতো অবরোধের মধ্যে, বন্দী থাকতো কঠোর আইনের বিধানে, এবং তাদের ওপর চোখ রাখতো বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটরা। সে সারাজীবনভর থাকতো চির-অপ্রাপ্তবয়স্ক, থাকতো একজনঅভিভাবকের কর্তৃত্বে; সে তার পিতা হতে পারতো, স্বামী হতে পারতো, স্বামীর উত্তরাধিকারী হতে পারতো, আর এসবের অবর্তমানে অভিভাবক হতো রাষ্ট্র, যার প্রতিনিধিত্ব করতো সরকারি কর্মকর্তারা। এরা ছিলো তার প্রভু, এবং কোনো বস্তুর মতো সে ছিলো তাদের অধিকারে; আর অভিভাবকদের কর্তৃত্ব প্রসারিত ছিলো তার শরীর ও সম্পত্তি পর্যন্ত। অভিভাবক ইচ্ছেমতো কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত করতে পারতো : পিতা তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারতো বা মেয়েকে দত্তক দিতে পারতো; স্বামী তার স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে আরেক স্বামীর কাছে হস্তান্তরিত করতে পারতো। তবে গ্রিক আইন স্ত্রীর জন্যে একটা পণের ব্যবস্থা করতো, যা ব্যয় হতো তার ভরণপোষণে এবং বিয়ে ভেঙে গেলে সেটার সবটা তাকে ফিরিয়ে দিতে হতো; আইন বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দিতে স্ত্রীকে; তবে এগুলোই ছিলো তাকে দেয়াসমাজের একমাত্র নিশ্চয়তা। সমস্ত ভূসম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পেতো পুত্ররা।
পুরুষপরম্পরা অনুসারে উত্তরাধিকারভিত্তিক সমাজে একটি সমস্যা দেখা দেয়, তা হচ্ছে যদি কোনো পুরুষের উত্তরাধিকারী না থাকে তখন ভূসম্পত্তির কী ব্যবস্থা হবে। গ্রিকরা এপিক্লেরেৎ নামে একটি প্রথা তৈরি করে : নারী উত্তরাধিকারীকে অবশ্যই তার পিতার পরিবারের জ্যেষ্ঠতম আত্মীয়কে বিয়ে করতে হতো; এভাবে পিতা তার জন্যে যে-সম্পত্তি রেখে যেতো, তা থেকে যেতো একই দলের সন্তানদের মধ্যে। এপিক্লেরে নারী উত্তরাধিকারী ছিলো না। ছিলোপুরুষ উত্তরাধিকারী উৎপাদনের উপায় মাত্র। এ প্রথা তাকে নিক্ষেপ করে পুরুষের দয়ার তলে, কেননা তাকে যান্ত্রিকভাবে দান করা হতো পরিবারের প্রথম জন্মপ্রাপ্ত পুরুষটির কাছে, যে অধিকাংশ সময়ই হতো বৃদ্ধ।