প্রাচ্যদেশীয় অনেক সমাজে লেভিয়েট নামে একটি প্রথা আছে। সব ব্যবস্থায়ই, যেখানে নারী থাকে কারোঅভিভাবকত্বে, সেখানে একটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যে কী করতে হবে বিধবাদের নিয়ে? চরম সমাধান হচ্ছে তাদের স্বামীর সমাধিতে উৎসর্গ করা। তবে ভারতেও এ-বিধান এমন ধ্বংসযজ্ঞকে অত্যাবশ্যক করে তোলে নি; মনুর বিধানে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবার বেঁচে থাকার অনুমতি আছে। সমারোহপূর্ণ আত্মহত্যাগুলো কখনোই অভিজাতদের একটা ঢঙ ছাড়া বেশি কিছু ছিলো না। সাধারণত বিধবাদের তুলে দেয়া হতো স্বামীর উত্তরাধিকারীদের হাতে। লেভিরেট প্রথা অনেক সময় রূপ নেয় একপত্নীবহুস্বামী বিয়ের; বিধবার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা দূর করার জন্যে একটি পরিবারের সব ভাইকে করা হতো একটি নারীর স্বামী, এ-প্রথা গোত্রকে স্বামীর সম্ভাব্য বন্ধ্যাত্বের সমস্যা থেকেও রক্ষা করতো। সিজারের এক বিবরণে পাওয়া যায় যে ব্রিটানিতে পরিবারের সব পুরুষের থাকতো কয়েকটি সাধারণ স্ত্রী।
সর্বত্র অবশ্য পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চরমরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ব্যাবিলনে হাম্মুরাবির বিধানে নারীদের দেয়াহয়েছিলো কিছু অধিকার; সে পৈর্তৃক সম্পত্তির কিছু অংশ পেতো, এবং তার বিয়ের সময় পিতা পণ দিতো। পারস্যে বহুবিবাহ ছিলো সামাজিক রীতি; সেখানে চাওয়া হতো যে স্ত্রী হবে স্বামীর একান্ত বাধ্য, বিয়ের বয়স হলে তার পিতা ঠিক করতো পাত্র; তবে অধিকাংশ প্রাচ্য সমাজের তুলনায় সেখানে স্ত্রী পেতো অনেক বেশি মর্যাদা। অজাচার নিষিদ্ধ ছিলো না, এবং ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হতো প্রায়ই। স্ত্রী পালন করতো সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব–ছেলেদের সাত বছর বয়স, আর মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত। পুত্র অযোগ্য হলে সে স্বামীর সম্পত্তির একটি অংশ পেতো; আর সে যদি হতো‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’, তাহলে পেতো অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের কর্তৃত্ব এবং যদি স্বামী কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র না রেখে মারা যেতো, তাহলে ব্যবসা চালানোর দায়িত্বও পেতো। বিয়ের বিধান স্পষ্টভাবে নির্দেশ করতো যে গৃহস্বামীর উত্তরপুরুষ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে প্রচলিত ছিলো পাঁচ ধরনের বিয়ে : (১) নারীর যদি পিতামাতার সম্মতিতে বিয়ে হতো, তাহলে তাকে বলা হতো ‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’; তার সন্তানেরা হতো তার স্বামীর। (২) যদি নারীটি পিতামাতার একমাত্র সন্তান হতো, তাহলে তার প্রথম সন্তানকে পাঠিয়ে দেয়া হতো তার পিতামাতার কাছে, যাতে সে তাদের মেয়ের স্থান নিতে পারে; এর পর স্ত্রীটি হতো ‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’। (৩) যদি কোনো পুরুষ অবিবাহিত অবস্থায় মারা যেতো, তার পরিবার পণ দিয়ে বিয়ের মাধ্যমে বাইরে থেকে গ্রহণ করতে কোনো নারীকে, তাকে বলা হতো ‘পোষ্য স্ত্রী’; তার অর্ধেক সন্তান হতো মৃতের, অর্ধেক হতো তার জীবিত স্বামীর। (৪) নিঃসন্তান কোনো বিধবা যদি বিয়ে বসতো, তাকে বলা হতো ‘বাঁদী স্ত্রী’; তার সন্তানদের অর্ধেক দিতে হতো তার মৃত স্বামীকে। (৫) যদি কোনো নারী পিতামাতার সম্মতি ছাড়া বিয়েবসতো, তাহলে সে পিতামাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো না, যতো দিন না তার জ্যেষ্ঠ পুত্র বয়োপ্রাপ্ত হয়ে নিজের মাকে তার পিতার কাছে ‘সুবিধাপ্রাপ্ত স্ত্রী’ হিসেবে দান করতো; এর আগেই স্বামী মারা গেলে তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য করা হতো এবং রাখা হতো কারো কর্তৃত্বে। প্রত্যেক পুরুষই যাতে উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারে পোষ্য স্ত্রী ও বাঁদী স্ত্রীর প্রথা সে-ব্যবস্থা করে, ওই সন্তানদের সাথে সে যদিও রক্তের সম্পর্কে জড়িত নয়। আমি ওপরে যা বলছিলাম এটা সেকথা প্রমাণ করে; পুরুষেরা যাতে মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে ও পাতাললোকে অর্জন করতে পারে অমরতা, সেজন্যেই পুরুষেরা উদ্ভাবনা করেছিলো এ-সম্পর্কটি।
মিশরেই শুধু নারীরা ছিলো সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায়। দেবী মাতারা স্ত্রী হওয়ার পরেও রক্ষা করতো তাদের মর্যাদা; দম্পতি ছিলো ধর্মীয় ও সামাজিক একক; নারীদের মনে করা হতো পুরুষের সঙ্গী ও পরিপূরক। তার ইন্দ্রজাল এতো কম বৈরি ছিলো যে এমনকি অজাচারের ভীতিকেও জয় করা হয়েছিলো এবং নির্দ্বিধায় সম্মিলিত করা হয়েছিলো বোন ও স্ত্রীকে। নারীদের ছিলো পুরুষদের মতো একই অধিকার, বিচারালয়ে ছিলো একই ক্ষমতা; নারী উত্তরাধিকারী হতো, সম্পত্তির মালিক হতো। এ-অসাধারণ সৌভাগ্যজনক পরিস্থিতি অবশ্য আকস্মিকভাবে ঘটে নি : এটা ঘটেছে এ-কারণে যে প্রাচীন মিশরে ভূসম্পত্তির মালিক ছিলো রাজা এবং উচ্চবর্ণের পুরোহিত ও সৈনিকেরা; সাধারণ মানুষেরা শুধু ভূমি ব্যবহার করতে এবার শস্য ভোগ করতে পারতো–ভূমি থাকতো মালিকদের সাথে অচ্ছেদ্য। উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সম্পত্তির বিশেষ মূল্য ছিলো না, এবং ভাগ করে দিতে কোনো অসুবিধা হতো না। উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি না থাকায় নারী রক্ষা করতে পারতো মানুষের মর্যাদা। বাধ্যবাধকতা ছাড়াই সে বিয়ে করতো এবং বিধবা হয়ে গেলে আবার নিজের ইচ্ছেমতো বিয়ে করতো। পুরুষেরা বহুবিবাহ করতো; সব সন্তানই যদিও ছিলো বৈধ, তবু একজনই থাকতোপ্রকৃত স্ত্রী, যে একা স্বামীর সাথে ধর্মকর্মে সঙ্গী ছিলো ও বৈধভাবে বিবাহিত ছিলো; অন্যরা ছিলো অধিকারহীন দাসী মাত্র। বিয়ের ফলে প্রধান স্ত্রীর মর্যাদা বদল ঘটতো না : সে মালিক থাকতো তার সম্পত্তির এবং স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারতো। যখন ফারাও বোখোরিস ব্যক্তিমালিকানা প্রবর্তন করে, তখন নারীরা এতো শক্তিশালী অবস্থানে ছিলো যে সে তাদের উৎখাত করতে পারে নি; বোখোরিস সূচনা করে চুক্তির কালের, এবং বিয়ে হয়ে ওঠে একটি চুক্তি।