যখন সে কিশোরী হয়ে ওঠে, তার ওপর থাকে তার পিতার সমস্ত কর্তৃত্ব; যখন তার বিয়ে হয়, তখন তার পিতা সে-কর্তৃত্ব কড়ায়গন্ডায় হস্তান্তরিত করে স্বামীর হাতে। স্ত্রী যেহেতু দাসের মতো, ভারবাহী পশুর মতো, বা অস্থাবর সম্পত্তির মতো স্বামীর সম্পত্তি, তাই পুরুষ স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে পারে যত ইচ্ছে তত স্ত্রী; শুধু আর্থনীতিক বিবেচনার ফলেই বহুবিবাহ থাকে বিশেষ সীমার মধ্যে। স্বামী নিজের খেয়ালে ছেড়ে দিতে পারে স্ত্রীদের, সমাজ তখনতাদের কোনোই নিরাপত্তা দেয় না। অন্যদিকে, নারীকে রাখা হয় কঠোর সতীত্বের মধ্যে। ট্যাবু থাকা সত্ত্বেও মাতৃধারার সমাজে মেনে নেয়া হয় আচরণের ব্যাপক স্বাধীনতা; বিবাহপূর্ব কুমারীত্ব সেখানে বিশেষ দরকার হয় না, এবং ব্যভিচারকেও বিশেষ কঠোরতার সাথে শাসন করা হয় না। এর বিপরীতে, যখন নারী হয়ে ওঠে পুরুষের সম্পত্তি, স্বামী চায় স্ত্রীটি হবে কুমারী এবং সে কঠোর দণ্ডের ভয় দেখিয়ে স্ত্রীর কাছে দাবি করে সম্পূর্ণ সতীত্ব। কোনো উপপতির সন্তানকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করার ঝুঁকি নেয়া হচ্ছে চরম অপরাধ; তাই দোষী স্ত্রীকে হত্যা করার সমস্ত অধিকার আছে গৃহস্বামীর। যতোদিন ব্যক্তিমালিকানা প্রথা টিকে থাকবে, স্ত্রীর অসতীত্বকে ততোদিন গণ্য করা হবে রাজদ্রোহিতার মত অপরাধ বলে। আইনের সমস্ত বিধি, যেগুলো আজো ব্যভিচারের ক্ষেত্রে মেনে চলে অসাম্য, সবগুলোই যুক্তি দাঁড়করায় স্ত্রীর মহাঅপরাধের ওপর, যে পরিবারের মধ্যে নিয়ে আসে একটি জারজ। এবং যদিও নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার অগাস্টাসের কাল থেকেই বিলুপ্ত, নেপোলিয়নি বিধি আজো জুরির অধিকার অর্পণ করে স্বামীর হাতে, যে নিজেই প্রয়োগ করেছে ন্যায়বিচার।
যখন স্ত্রীটি একই সময়ে অন্তর্ভুক্ত হতো পৈতৃক গোত্রে ও দাম্পত্য পরিবারের, তখন সে দু-ধরনের বন্ধনের মধ্যে বেশ খানিকটা স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারতো; এবন্ধন দুটি ছিলো বিশৃঙ্খল ও এমনকি পরস্পরবিরোধী, যার একটি স্ত্রীটিকে রক্ষা করতো অন্যটি থেকে : উদাহরণস্বরূপ, প্রায়ই সে নিজের পছন্দমতো স্বামী গ্রহণ করতে পারতো, কেননা বিয়ে ছিলো একটা ঐহিক ঘটনা মাত্র, যা সমাজের মৌল সংগঠনের ক্ষতি করতো না। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে তার পিতার সম্পত্তি, যে তার সুবিধামতো মেয়েকে বিয়ে দিতো। তারপর স্বামীর চুলোর সাথে জড়িয়ে থেকে সে স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তির বেশি কিছু হতো না এবং হতো সে-গোত্রের অস্থাবর সম্পত্তি, যাতে ফেলা হয়েছে তাকে।
যখন পরিবার ও ব্যক্তিমালিকানানির্ভর উত্তরাধিকার প্রশ্নহীনভাবে থাকে সমাজের ভিত্তি, তখন নারী থাকে সম্পূর্ণরূপে অধীনস্থ। এটা ঘটে মুসলমান জগতে। এর সংগঠন সামন্ততান্ত্রিক; অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রই বিভিন্ন গোত্রকে সমন্বিত ও শাসন করার মতো শক্তি অর্জন করেনি : পিতৃতান্ত্রিক প্রধানের ক্ষমতা খর্ব করার মতো কারো শক্তি নেই। আরবরা যখন রণলিপ্সু ও বিজয়ী ছিলো তখন সৃষ্টি হয়েছিলো ধর্মটি, সেটি নারীকে করেছে প্রচন্ড অবজ্ঞা। কোরানঘোষণা করেছে : ‘পুরুষ নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ কেননা আল্লা তাকে বিশেষ গুণ দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বে ভূষিত করেছে এবং এজন্যে যে তারা নারীদের উপঢৌকন দেয়’; সেখানে নারীদের কখনো প্রকৃত ক্ষমতা ছিলো না। অতীন্দ্রিয় মর্যাদাও ছিলো না। বেদুইন নারী কঠোর পরিশ্রম করে, সে হাল চাষ করে ও বোঝা বহন করে : এভাবে সে তার স্বামীর সাথে স্থাপন করে একটা পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক; সে মুখ খোলা রেখে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। বোরখায় ঢাকা ওঅবরোধবাসিনী মুসলমান নারী আজো অধিকাংশ সামাজিক স্তরে একধরনের দাসী।
তিউনিশিয়ার এক আদিম পল্লীর ভূগর্ভস্থ এক গুহার ভেতরে বসে থাকা চারটি নারীকে আমি দেখেছিলাম, তাদের কথা আমার মনে পড়ছে : বৃদ্ধা এক চোখ কানা দাঁতহীন স্ত্রীটি, যার মুখমণ্ডল ভীষণভাবে বিধ্বস্ত, একটি ছোট্ট মালশার ওপরে তীব্র ঝাঁজালো ধোঁয়ার মধ্যে রাঁধছিলো ময়দার পিণ্ড; আরো দুটি স্ত্রী, কিছুটা কম বয়সের, কিন্তু একই রকমে বিধ্বস্ত, শিশু কোলে নিয়ে বসে ছিলো, একজন বুকের দুধ দিচ্ছিলো শিশুকে; আর তাঁতের সামনে বসে রেশম, সোনা, আর রুপোতে অলঙ্কৃত প্রতিমার মতো এক তরুণী বুনছিলো পশম। আমি যখন সেই বিষাদাচ্ছন্ন গুহাসীমাবদ্ধতা, জরায়ু, ও সমাধির রাজ্য-ছেড়ে বারান্দা দিয়ে ওপরে দিনের আলোর দিকে এলাম, তখন দেখলাম পুরুষটিকে, সে পরেছে শুভ্র পোশাক, অত্যন্ত সুসজ্জিত, মুখে হাসি, ঝলমলে। সে বাজার থেকে ফিরছিলো, যেখানে সে অন্যান্য পুরুষের সাথে বিশ্বের নানা কথা বলেছে; সে যে-বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত, যে-বিশ্ব থেকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, তার সে-বিশাল বিশ্বের কেন্দ্র অবস্থিত এ-বিশ্রামস্থলে সে কয়েক ঘন্টা কাটাবে। ওই বৃদ্ধা জীর্ণ নারীদের জন্যে, আর ওই তরুণীটির জন্যে, যে ওই বৃদ্ধাদের মতোই দ্রুত ক্ষয় হয়ে যাবে, এ-ধোঁয়াচ্ছন্ন গুহা ছাড়া আর কোনো বিশ্ব নেই; এ-গুহা থেকে তারা বেরোয় শুধু রাতে, নিঃশব্দে, বোরখায় ঢেকে।
বাইবেলের সময়ের ইহুদিদের ছিলো এ-আরবদের মতো একই প্রথা। গৃহপতিরা ছিলো বহুবিবাহকারী; আর তারা খেয়ালখুশি মতো ছেড়ে দিতে পারতো স্ত্রীদের; বিয়ের সময় তরুণী স্ত্রীকে অবশ্যই হতে হতো কুমারী, নইলে বিধান ছিলো কঠোর শাস্তির; ব্যভিচার ঘটলে স্ত্রীকে হত্যা করা হতো পাথর ছুঁড়ে; স্ত্রীকে রাখা হতো গৃহস্থালির কাজের মধ্যে বন্দী, যেমন প্রমাণ করে বাইবেলের সতী ভার্যার চিত্র : ‘সে চায় পশম ও শণ… সে রাত থাকতে ওঠে… রাতেও তার প্রদীপ নেভে না… সে আলস্যের অন্ন গ্রহণ করে না’। যদিও সে সতী ও পরিশ্রমী, কিন্তু অনুষ্ঠানাদিতে সে অশুচি, ট্যাবুতে ঢাকা; বিচারালয়ে তার সাক্ষ্য গৃহীত হয় না। ইক্লিজিয়াসটেস নারী সম্পর্কে প্রকাশ করেছে জঘন্যতম ঘৃণা : ‘আমি নারীকে মৃত্যুর থেকেও বিষাক্ত দেখি, যার মন হচ্ছে ফাঁদ ও জাল, এবং তার হাত হচ্ছে পাশ… সহস্রের মধ্যে আমি অন্তত একটি পুরুষ পেয়েছি; কিন্তু ওই সবগুলোর মধ্যেও আমি একটি নারী পাই নি’। ধর্মের বিধান না হলেও সামাজিক প্রথা ছিলো যে স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবাটি তার ভাইদের কোনো একজনের কাছে বিয়ে বসবে।