এবং তবুও শুভর দরকার অশুভ, ভাবের দরকার, এবং আলোর দরকার অন্ধকার। পুরুষ জানে তার বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে, তার জাতিকে স্থায়িত্ব দেয়ার জন্যে নারী অপরিহার্য; নারীকে তার দিতে হবে সমাজে একটি অবিচ্ছেদ্য স্থান : পুরুষ যে-শৃঙ্খলা স্থাপন করেছে, নারী তা যতোটা মেনে চলবে, তাকে ততোটা মুক্ত করা হবে তার আদিকলঙ্ক থেকে। এ-ধারণাটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে মনুর বিধানে : বৈধ বিবাহের মাধ্যমে নারী অর্জন করে তার স্বামীর গুণাবলি, নদী যেমন সমুদ্রে হারায় নিজেকে, এবং মৃত্যুর পর তাকে স্থান দেয়া হয় একই স্বর্গে। একইভাবে বাইবেলেও অঙ্কিত হয়েছে সতীনারীর এক প্রশংসিত চিত্র (প্রবাদ ২১, ১০-৩১)। খ্রিস্টধর্ম মাংসকে ঘৃণা করলেও শ্রদ্ধা করে পবিত্র কুমারীকে, সতী ও অনুগত স্ত্রীকে। ধর্মসাধনে সহচরী হিশেবে নারী পালন করতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ভূমিকা : ভারতে ব্রাহ্মণী, রোমে ফ্ল্যামিনিকা উভয়ই তাদের পতিদের মতো পবিত্র। যুগলের মধ্যে পুরুষটিই প্রাধান্য করে, তবে প্রজননের জন্যে, জীবন নির্বাহের জন্যে, এবং সমাজের শৃঙ্খলার জন্যে দরকার হয় পুরুষ ও নারী নীতির মিলন।
অপর-এর, নারীর, এ-পরস্পর বিপরীত মূল্যই প্রতিফলিত হবে তার বাকি ইতিহাসে; আমাদের কাল পর্যন্ত তাকে রাখা হবে পুরুষের ইচ্ছের অধীনে। তবে এটা হবে দ্ব্যর্থক : সম্পূর্ণরূপে অধিকারে ও নিয়ন্ত্রণে এনে নারীকে নামিয়ে দেয়া হবে বস্তুর পর্যায়ে; তবে পুরুষ যাই জয় ও অধিকার করে, তাকেই আবৃত করে দিতে চায় নিজের গৌরবে; পুরুষের কাছে মনে হয় যে অপর এখনো ধারণ করে আছে তার কিছুটা আদিম ইন্দ্রজাল। কী করে স্ত্রীকে একইসঙ্গে দাসী ও সঙ্গিনী করা যায়, এ-সমস্যাটিকে সে সমাধান করার চেষ্টা করবে, তার মানসিকতার বিবর্তন ঘটতে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে; এবং ঘটাতে থাকবে নারীর নিয়তিরও বিবর্তন।
পিতৃতান্ত্রিক কাল ও ধ্রুপদী মহাযুগ
প্রথম খণ্ড । ভাগ ২ – ইতিহাস । পরিচ্ছেদ ৩
নারী সিংহাসনচ্যুত হয়েছিলো সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার আগমনে, এবং শতাব্দী পরম্পরায় তার ভাগ্য জড়িয়েআছে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার সঙ্গে : তার ইতিহাসের বড়ো অংশই জড়িত উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিষয়সম্পত্তির ইতিহাসের সাথে। এ প্রথার মৌলিক গুরুত্ব বোঝা যায় সহজে যদি একথা মনে রাখি যে মালিক তার অস্তিত্ব স্থানান্তরিত, বিচ্ছিন্ন করে তার সম্পত্তির মধ্যে; সে একে নিজের জীবনের থেকেও বেশি মূল্য দেয়; এটা প্রবাহিত হয় এ-মরজীবনের সংকীর্ণ সীমা পেরিয়ে, এবং শরীর মাটিতে মিশে যাওয়ার পরও টিকে থাকে–ঘটে অমর আত্মার পার্থিব ও বস্তুগত একত্রীভবন। তবে এ-বেঁচে থাকা সম্ভব হয় যদি সম্পত্তি থাকে মালিকের হাতে : মৃত্যুর পরও এটা তার হতে পারে যদি এটা তাদের অধিকারে থাকে, যাদের মধ্যে সে নিজেকে প্রক্ষেপিত দেখতে পায়, যারা তার। সুতরাং পুরুষ নারীর সাথে তার দেবতা ও সন্তান ভাগাভাগি করে নিতে রাজি নয়। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার কালে পুরুষ সম্পত্তির মালিকানা ও দানের সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নেয় নারীর কাছে থেকে।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে, তার কাছে এটা যুক্তিসঙ্গতই মনে হয়েছিলো। যখন স্বীকার করা হয় যে নারীর সন্তানেরা আর তার নয়, ওই স্বীকৃতি অনুসারেই নারীটি যে-দল থেকে এসেছে, তার সাথে সন্তানদের কোনো বন্ধন থাকে না। বিয়ের মাধ্যমে নারী আর এক গোত্রের কাছে থেকে আরেক গোত্রের ঋণগ্রহণ নয় : সে যে-গোত্রে জন্মেছিলোসে-গোত্র থেকে সমূলে উৎপাটিত করে আনা হয় তাকে, এবং অন্তর্ভুক্ত করা হয় স্বামীর দলে; স্বামী তাকে কেনে যেমন কেউ কেনে গোয়ালের জন্যে পশু বা দাস; স্বামী তার ওপর চাপিয়ে দেয় তার গৃহদেবতাদের; এবং নারীটির গর্ভের সন্তানেরা অন্তর্ভুক্ত হয় স্বামীর পরিবারের। যদি নারী উত্তরাধিকারী হতো, তাহলে সে পিতার পরিবারের বেশ কিছু সম্পত্তি হস্তান্তরিত করতে স্বামীর পরিবারে; তাই সযত্নে তাকে বাদ দেয়া হয় উত্তরাধিকার থেকে। উল্টোভাবে, যেহেতু নারী কিছুর মালিক নয়, সে মানুষের মর্যাদাও পায় না; সে নিজেই হয়ে ওঠে পুরুষের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তির অংশ : প্রথমে পিতার, পরে স্বামীর। কঠোর পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পিতা জন্মের মুহূর্ত থেকে পুত্র ও কন্যা সন্তানদের হত্যা করতে পারে; কিন্তু পুত্রের বেলা সমাজ অস্বাভাবিকভাবে খর্ব করে তার ক্ষমতা : প্রতিটি সুস্থ নবজাতক পুত্রকে বাঁচতে দেয়া হয়, অন্যদিকে শিশুকন্যাদের অরক্ষিত রাখার রীতি ছিলো খুবই ব্যাপক। আরবদের মধ্যে শিশুহত্যা ছিলো ব্যাপক : জন্মের সাথে সাথেই কন্যাশিশুদের গর্তে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো। শিশু কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখা ছিলোপিতার বিশেষ মহানুভবতা; এমন সমাজে পুরুষের বিশেষ দয়ায়ই নারী বেঁচে থাকতে পারে, পুত্রের মতো বৈধভাবে নয়। প্রসবের পর প্রসূতির অশৌচের কাল হয় দীর্ঘতর যদি শিশুটি হয় মেয়ে : হিব্রুদের মধ্যে, লেভিটিকাস নির্দেশ দিয়েছে পুত্র জন্ম নিলে যতো দিন অশৌচ পালন করতে হবে কন্যা জন্ম নিলে অশৌচ পালন করতে হবে তার থেকে দুমাস বেশি। যে-সব সমাজে ‘রক্তের মূল্য’-এর প্রথা আছে, সেখানে নিহত ব্যক্তিটি স্ত্রীলিঙ্গের হলে মূল্য হিশেবে দাবি করা হয়অল্প মুদ্রা : পুংলিঙ্গের সাথে তুলনায় তার মূল্য ততোটা একজন স্বাধীন পুরুষের তুলনায় একটি দাসের মূল্য যতোটা।