বিশশতকের প্রথমার্ধ ছিলো নারীদের জন্যে এক অন্ধকার মুক্তির সময়, মুক্তির কথা স্তব্ধ হয়ে গেছে, নারীদের ধাক্কিয়ে আবার ঢুকানো হচ্ছে ঘরসংসাড়ে, বড়ো ক’রে তোলা হয়েছে ‘নারী চিরন্তনী কে, ওই অন্ধকারের মধ্যে দিব্য অরুণের মতো দেখা দেয় দ্য বোভোয়ারের ল্য দাজিয়েম সেক্স (১৯৪৯: দ্বিতীয় লিঙ্গ); এটি হয়ে উঠে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর পরিস্থিতির এক ধ্রুপদী দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, রাজনীতিক ভাষ্য, হয়ে ওঠে নবনারীদের মূলগ্রন্থ। ল্য দ্যজিয়েম সেক্সকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই ভিন্ন মনে হয় মেরি ওলস্টোনক্রাফট্এর ভেন্ডিকেশন থেকে, অনেক জটিল অনেক প্রাজ্ঞ এ-বই মেরির বইটি থেকে, মেরির বইয়ের ক্রোধ ও আক্রমণ নেই এতে, এমনকি তিনি কোনো দাবিও জানান নি, তিনি ব্যাখ্যা ও উদঘাটন করেছেন নারীর পরিস্থিতি, তবে এতে চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে সে চিন্তাভাবনা, যার উন্মেষ ঘটেছিলো মেরির বইতে। মেরির আক্রমণের একটি বিষয় চিরন্তনী নারী ধারণা, যা পিতৃতন্ত্রের ধর্মে দর্শনে সাহিত্যে এবং সবকিছুতে এক ধ্রুব ব্যাপার বলে গৃহীত, মেরি তা বাতিল ক’রে দেন; দ্য বোভোয়ারের প্রধান বিষয় এটিই, তবে তিনি মেরির মতো আক্রমণ করেন। নি, ধর্ম পুরাণ মনোবিজ্ঞান সাহিত্য ঘেটে দেখান এর অসারত্ব। তিনি বলেছেন, “বিধানকর্তারা, পুরোহিতেরা, দার্শনিকেরা, লেখকেরা, এবং বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে নারীর অধীন অবস্থান স্থির হয়েছে স্বর্গে এবং মর্ত্যে এটা সুবিধাজনক। পুরুষের উদ্ভাবিত ধর্মগুলোতে প্রতিফলিত হয় আধিপত্যের এ-বাসনা।’
তাঁর বিষয় সভ্যতায় নারীর পরিস্থিতি; এটা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ‘অস্তিত্ববাদী নীতিশাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে’। তাঁর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে আমরা মানুষ, কেননা আমরা পেরিয়ে যাই প্রকৃতিকে; মানুষ হওয়ার অর্থ ক্ৰমশ হয়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া, আবিষ্কার করা, সৃষ্টি করা, জীবনের মূল্য শুধু বেঁচে থাকায় নয়, বরং জীবনকে নিরস্তুর বিকশিত করার মধ্যে। মানবমগুলিতে আছে দুটি লিঙ্গ : পুরুষ ও নারী; এর মাঝে পুরুষ ‘বদলে দেয় পৃথিবীর মুখমণ্ডল, সে নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করে, আবিষ্কার করে, সে গঠন করে ভবিষ্যতের রূপ’; আর এটাই তাকে ভিন্ন ক’রে তোলে পশুর থেকে। আমাদের সংজ্ঞা কী? কর্ম ও আকাংখাই সংজ্ঞায়িত করে আমাদের। প্রজননের মাধ্যমে কেউ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, হয়ে উঠতে হয় সৃষ্টি ও নির্মাণের মধ্য দিয়ে; তিনি বলেছেন, ‘স্ত্রীলিঙ্গ তাঁর প্রজাতির শিকার।’ পুরুষ নিজেকে মুক্ত ক’রে নেয় নিরর্থক জৈবিক পুনরাবৃত্তির কবল থেকে, নিরন্তর চেষ্টা করে নিজের জন্যে অধিকতর স্বাধীনতা সৃষ্টির। কিন্তু নারী? নারীর শোচনীয় ট্র্যাজেডি হচ্ছে ইতিহাসব্যাপী তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে আকাঙ্খা ও উচ্চাভিলাষের অধিকার থেকে, তাকে মানুষ হয়ে উঠতে দেয়া হয় নি। তিনি ব্যবহার করেছেন দুটি ধারণা : আত্ম (সেম্বফ) ও অপর (আদার), যে-দুটিকে তিনি মানবিক চেতনার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাঁর মতে, প্রতিটি চেতনা বিরূপ অন্য প্রতিটি চেতনার প্রতি: একটি চেতনা নিজেকে ক’রে তোলে কর্তা, প্রয়োজনীয় বা অবধারিত, আর সে অন্য চেতনাকে ক’রে তোলে কর্ম, অপ্রয়োজনীয়, আকস্মিক! নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পারস্পরিকতা রক্ষা করা হয় নি, পুরুষ নারীকে ক’রে তুলেছে চিরন্তন ‘অপর’, তাকে ক’রে তুলেছে কর্ম, কখনো কর্তা হয়ে উঠতে দেয় নি! তাই নারী হয়ে আছে প্রকৃতি, রহস্যময়ী, অ-মানুষ; মানুষ হিশেবে তাঁর মূল্য নেই, তাঁর মূল্য অমূর্ত ধারণার প্রতিরূপ হিশেবে। নারী যতো দিন নারী হয়ে থাকবে ততো দিন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না। তিনি অসামান্যরূপে ব্যাখ্যা করেছেন কিংবদন্তি বা পুরাণে এবং সাহিত্যে নারীর বাভমূর্তি; আক্রমণ করেছেন উৎপাদিত অসার নারীভাবমূর্তিকে। বলেছেন, ‘পুরুষের দাসী না হ’লেও নারী সময়ই আশ্রিত থেকেছে পুরুষের; এ-দুটি লিঙ্গ কখনো পৃথিবীকে সমভাবে ভোগ করেনি। তিনি অস্তিত্ববাদী দর্শন ব্যাবহার করেছেন, তাঁর দর্শন পুরোপুরি গহণযোগ্য নাও হ’তে পারে, কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা নির্ভুল। তিনি দেখিয়েছেন যে প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই পুরুষ নিজেকে ক’রে তুল্বছ্ব মানুষের পরম রূপ, অর্থাৎ পুরুষই মানুষ, আর নারী নিতান্তই নারী; পুরুষ হচ্ছে মানুষকে মাপার মানদণ্ড, নারীকে ওই মানদণ্ডে মেপে ঘোষণা করা হয়েছে নিকৃষ্ট বলে। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর প্রথম খণ্ডে তিনি অপূর্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুরুষের পক্ষপাতিত্বের; দেখিয়েছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে”; অৰ্থাৎ পিতৃতন্ত্র ছাঁচে ঢালাই ক’য়ে উৎপাদনা করে একটি উপভোগ্য বস্তু : নারী। পুরুষ করে তুলেছে প্ৰভু; তিনি বলেছেন, ‘বহু শব্দ অনেক সময় ব্যবহৃত হয় চরম আক্ষরিক অর্থে, যেমন ফ্যালাস (শিশ্ন) শব্দটি বুঝিয়ে থাকে মাংসের সে-উত্থান, যা নির্দেশ করে পুরুষকে, তারপর এগুলোকে সম্প্রসারিত করা হয় সীমাহীনভাবে এবং দেয়া হয় প্রতীকী অর্থ, তাই শিশ্ন এখন বুঝিয়ে থাকে পৌরুষ ও তাঁর পরিস্থিতি। পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা সৃষ্টি করেছে যে শিশ্নই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। ধনাত্মকতা ও ঋণাত্মকতার, বা বৈপরীত্যের যে-ধারণা পরে প্রধান হয়ে ওঠে ভাষাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ও অন্যান্য বিদ্যায়, তা তিনি চমৎকারভাবে প্রয়োগ করেন। নারী ও পুরুষ ব্যাখ্যায়; দেখান যে পুরুষতন্ত্র তৈরি করেছে একরাশ বিপৰীত ধারণা, যার একটি ধনাত্মক বা প্রয়োজনীয় বা কর্তা, আরেকটি ঋণাত্মক বা অপ্রয়োজনীয় বা কর্ম, যেমন : পুংলিঙ্গ : স্ত্রীলিঙ্গ, সংস্কৃতি : প্রকৃতি, মানুষ : পশু, উৎপাদন : প্রজনন, সক্রিয় : অক্রিয়; এগুলোর মধ্যে প্রথমটি শুভ, বিপরীতটি অশুভ, এবং পুরুষতন্ত্র প্রথমটি রেখেছে নিজের জন্যে, বিপরীতটি নারীর জন্যে। তিনি বাতিল করেছেন ‘চিরন্তনী নারীত্ব’কে, তবে তিনি পুরুষকেই মানবমগুলির প্রতিনিধি হিশেবে গ্ৰহণ করেছেন, এবং নারীর জন্যে চেয়েছেন পুরুষেরই গুণ, যেমন বহু আগে অন্ধকারতম অঞ্চলের এক নারীবাদী, রোকেয়া, পুরুষকে প্ৰচণ্ড আক্রমণ, নিন্দা, পরিহাসের পর বলেছিলেন, ‘আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ।’ রোকেয়া পুরুষকে বলেছেন অপদাৰ্থ দুশ্চরিত্র পাপিষ্ঠ শয়তান পাশবিক, দ্য বোভোয়ার এমন তিরষ্কার করেন নি; রোকেয়া বলেছিলেন, ‘পুরুষদের স্বার্থ ও আমাদের স্বাৰ্থ ভিন্ন নহে- একই। তাহদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই’; দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ‘বিদ্যমান বিশ্বের মাঝে মুক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে পুরুষকেই। এ-পরম বিজয় লাভের জন্যে, এক দিকে, এটা দরকার যে পুরুষ ও নারীরা তাদের প্রাকৃতিক পার্থক্যকরণের সাহায্যে ও মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীনভাবে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করবে তাদের ভ্ৰাতৃত্ববোধ।’ রোকেয়ায় এ-ভ্রাতৃত্ববোধ নেই, রয়েছে একটা বিরোধ, কিন্তু দ্য বোভোয়ার চেয়েছেন নারী ও পুরুষের সাম্য ও প্রীতিপূর্ণ বিকাশ।