নতুন কৌশলগুলো খুলে দিয়েছিলো যে-সব সম্ভাবনা, পুরুষ চেয়েছিলো সেগুলো চূড়ান্তরূপে বাস্তবায়িত করতে : সে কাজে লাগাতে থাকে দাসশ্রমশক্তি, সহকর্মী পুরুষদের সে পরিণত করে দাসে। নারীদের শ্রমের থেকে দাসদের শ্রম যেহেতু ছিলো অনেক বেশি কার্যকর, তাই গোত্রের মধ্যে নারী যে-আর্থনীতিক ভূমিকা পালন করতো, তা সে হারিয়ে ফেলে। নারীর ওপর সীমিত কর্তৃত্বের থেকে দাসের সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে প্রভু পেতো তার সার্বভৌমত্বের অনেক বেশি আমূল স্বীকৃতি। তার। উর্বরতার কারণে পুরুষ তাকে ভক্তি ও ভয় করতে বলে, পুরুষের কাছে সে অপর ছিলো বলে, এবং অপর-এর উদ্বেগজাগানো চরিত্রের সে অংশী ছিলো বলে, নারী এক রকমে তার ওপর নির্ভরশীলতায় আবদ্ধ রাখতো পুরুষকে, এবং একই সময়ে সে নির্ভরশীল থাকতো পুরুষের ওপর; প্রকৃতপক্ষে সে উপভোগ করতে প্রভু-দাসের সম্পর্কের পারস্পরিকতা, এবং এভাবে সে এড়িয়ে যায় দাসত্বকে। এবং দাস কোনো ট্যাবু দিয়ে সুরক্ষিত ছিলো না, দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ একটি পুরুষ ছাড়া সে আর কিছু ছিলো না, ভিন্ন নয় তবে নিকৃষ্ট : তার প্রভুর সাথে তার সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক প্রকাশ পেতে বহু শতাব্দী কেটি যায়। সুসংগঠিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দাস ছিলো মানুষের মুখধারী এক ভারবাহী পশু; প্রভু তার ওপর প্রয়োগ করতো স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্ব, যা মহিমান্বিত করতে তার গর্বকে–এবং সে দাঁড়ায় নারীর বিরুদ্ধে। পুরুষ যা কিছু অর্জন করে, তা অর্জন করে নারীর বিরুদ্ধে, পুরুষ যতো শক্তিশালী হয়, ততো পতন ঘটে নারীর।
বিশেষ করে, সে যখন হয়ে ওঠে ভূমির মালিক, তখন সে দাবি করে নারীরও মালিকানা। আগে সে আবিষ্ট ছিলো মানা দিয়ে, ভূমি দিয়ে; এখন তার আছে একটি আত্মা, তার আছে কিছুটা ভূমি; নারীর থেকে মুক্তি পেয়ে এখন সে নিজের জন্যে দাবি করে নারী এবং উত্তরপুরুষ। সে চায় যে সাংসারিক কাজকর্ম সবই হবে তার নিজের, এর অর্থ হচ্ছে সব কর্মীর মালিক হবে সে নিজে; সুতরাং সে দাস করে তোলে তার স্ত্রী ও সন্তানদের। উত্তরাধিকারী তার প্রয়োজন, যাদের মধ্য দিয়ে দীর্ঘায়িত হবে তার পার্থিব জীবন, কেননা সে তাদের হাতে দিয়ে যাবে তার সম্পত্তি; এবং মৃত্যুর পর তার আত্মার শান্তির জন্যে তারা পালন করবে নানা কৃত্যানুষ্ঠান। ব্যক্তিমালিকানার ওপর স্থাপিত হয় গৃহদেবতাপ্রথা, এবং উত্তরাধিকারী সম্পন্ন করে এমন একটি কাজ, যা একই সঙ্গে আর্থনীতিক ও অতীন্দ্রিয়। তাই যেদিন কৃষিকাজ আর ঐন্দ্রজালিক কর্ম থাকে না, হয়ে ওঠে এক সৃষ্টিশীল কাজ, পুরুষ বুঝতে পারে সে এক সৃষ্টিশীল শক্তি, সেদিন একই সাথে সে অধিকার দাবি করে নিজের সন্তান ও শস্যের ওপর।
আদিম কালে মাতৃধারার স্থানে পিতধারার প্রতিষ্ঠার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভাবাদর্শগত বিপ্লব ঘটে নি; তারপর মাতা পতিত হয় ধাত্রী ও দাসীর শ্রেণীতে, কর্তৃত্ব ও অধিকার থাকে পিতার হাতে, যা সে অর্পণ করে যায় উত্তরাধিকারীদের হাতে। সন্তান উৎপাদনে পুরুষের ভূমিকা তখন বোঝা হয়ে গেছে, তবে এছাড়াও দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করা হয় যে শুধু পিতাই জন্ম দেয়, মা শুধু তার দেহের ভেতরে প্রাপ্ত জীবাণুটির পুষ্টি যোগায়, যেমন এস্কিলুস বলেছেন ইউমেনিদেস-এ। আরিস্ততল বলেছেন নারী বস্তুমাত্র, আর সেখানে পুরুষ-নীতি হচ্ছে গতি, যা উক্তৃষ্টতর ও অধিক স্বর্গীয়। উত্তরপুরুষকে একান্তভাবে নিজের করে নিয়ে পুরুষ অর্জন করে পৃথিবীর ওপর আধিপত্য ও নারীর ওপর প্রভুতু। যদিও প্রাচীন পুরাণে ও গ্রিক নাটকে এটাকে দেখানো হয়েছে একটি প্রচণ্ড সগ্রামের পরিণতি হিশেবে, কিন্তু আসলে পিতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছিলো একটি ক্রমসংঘটিত পরিবর্তন। পুরুষ শুধু তাই পুনরায় জয় করে নেয়, যা একদা ছিলো তারই অধিকারে, সে আইনপদ্ধতিকে করে তোলে বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোনো যুদ্ধ হয় নি, কোনো জয় ছিলো না, পরাজয় ছিলো না।
তবে এ-প্রাচীন কিংবদন্তিগুলোর আছে সুগভীর অর্থ। যে-মুহূর্তে পুরুষ দৃঢ়ভাবে নিজেকে ঘোষণা করে কর্তা ও স্বাধীন ব্যক্তিরূপে, তখনই দেখা দেয় অপর ধারণাটি। সেদিন থেকেই অপর-এর সাথে সম্পর্কটি হয় নাটকীয় : অপর-এর অস্তিত্ব হচ্ছে একটি হুমকি, একটি বিপদ। প্রাচীন গ্রিক দর্শন দেখিয়েছে যে বিকল্পতা, অপরত্ব হচ্ছে নেতির মতোই জিনিশ, তাই অশুভ। অপরকে উত্থাপন করাই হচ্ছে এক ধরনের ম্যানিকীয়বাদ সংজ্ঞায়িত করা। এ-কারণেই ধর্মগুলো আর আইনের বিধানগুলো এতো বৈরী আচরণ করে নারীর সাথে। মানবজাতি যে-সময়ে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে পুরাণ ও আইন, তখন চূড়ান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা : পুরুষই বিধিবদ্ধ করতে থাকে নানা বিধান। নারীকে অধীন অবস্থান দেয়া তাদের জন্যে ছিলো খুবই স্বাভাবিক, তবু ভাবতে পারি যে পুরুষ সন্তান ও গবাদিপশুর প্রতি যতোটা সদয়তা দেখিয়েছে, তা সে দেখাতে পারতো নারীর প্রতিও–কিন্তু একটুও দেখায় নি। নারীপীড়নের বিধিবিধান প্রণয়ন করতে করতে বিধানকর্তারা ভয় পায় নারীকে। নারীর ওপর এক সময় আরোপ করা হয়েছিলো যে-দুটি বিপরীত শক্তি, তার থেকে এখন তার জন্যে রাখা হয় শুধু অশুভ বৈশিষ্ট্যগুলো : একদা পবিত্র, এখন সে হয় দূষিত। আদমের সহচরীরূপে দেয়া হয়েছিলো যে-হাওয়াকে, সে সম্পন্ন করে মানবজাতির বিনাশ; পৌত্তলিক দেবতারা যখন মানুষের ওপর চরিতার্থ করতে চেয়েছিলো প্রতিহিংসা, তখন তারা উদ্ভাবন করেছিলো নারী; এবং নারীজীবদের মধ্যে প্রথম জন্ম নিয়েছিলো যে, সেই প্যান্ডোরা মানুষের জন্যে খুলে দিয়েছিলো সমস্ত দুর্ভোগগুলো। তাই নারী অশুভের কাছে উৎসর্গিত। আছে এক শুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে শৃঙ্খলা, আলোক, ও পুরুষ; এবং এক অশুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার, ও নারী, বলেছেন পিথাগোরাস। মনুর বিধানে নারী গর্হিত সত্তা, যাকে করে রাখতে হবে দাসী। লেভিটিকাস নারীকে তুলনা করেছে গৃহপতির ভারবাহী পশুর সাথে। সোলোনের বিধানে নারীকে কোনো অধিকার দেয়া হয় নি। রোমান বিধি তাকে রেখেছে অভিভাবকের অধীনে, তার মধ্যে দেখেছে মৃঢ়তা। গির্জার বিধান তাকে নির্দেশ করেছে শয়তানের প্রবেশপথ বলে। কোরানে নারীকে করা হয়েছে প্রচণ্ড তিরষ্কার।