পুরুষ বুঝতে পারে তার শক্তি। তার সৃষ্টিশীল বাহুর সাথে তার তৈরি বস্তুর সম্বন্ধ থেকে সে বুঝতে পারে কার্যকারণ : বপন করা বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটতে পারে, আবার নাও পারে, কিন্তু আগুনের সংস্পর্শে পান দেয়ার সময়, যন্ত্রপাতি তৈরির সময় ধাতু সব সময়ই সাড়া দেয় একই ভাবে। যন্ত্রপাতির জগতটিকে বোঝা সম্ভব স্পষ্ট ধারণা অনুসারে : এখন দেখা দিতে পারে যৌক্তিক চিন্তা, যুক্তি ও গণিত। সম্পূর্ণ বর্জন করা হয় বিশ্ব সম্পর্কে পূর্ববর্তী ধারণা। নারীর ধর্ম অবদ্ধ ছিলো কৃষির রাজত্ব কালের সাথে, অপর্যবসেয় সময়কালের, আকস্মিকতার, সুযোগের, প্রতীক্ষার, রহস্যের রাজত্ব কালের সাথে; হোমো ফাবের-এর রাজত্বকাল হচ্ছে স্থান অনুসারে সময়কে নিয়ন্ত্রণের, প্রয়োজনীয় ফলাফলের, পরিকল্পনার, কর্মের, যুক্তির রাজত্বকাল। এমনকি যখন সে জমিতে কাজ করে, তখনও সে এতে কাজ করে যন্ত্রকুশল পুরুষরূপে; সে আবিষ্কার করে যে মাটিকে উর্বর করা যায়, জমিকে পতিত রাখা ভালো, এই-এই বীজ ব্যবহার করতে হবে এই-এইভাবে। সে শস্যকে ফলতে বাধ্য করে; সে খাল খোঁড়ে, জল সেঁচে বা নিষ্কাশন করে, সে রাস্তা বানায়, মন্দির তৈরি করে : সে সৃষ্টি করে এক নতুন বিশ্ব।
যে-সব মানবগোষ্ঠি থেকে যায় দেবী মহামাতার নিয়ন্ত্রণে, যারা রক্ষা করে চলে মাতধারার শাসন, তারা বন্দী হয়ে পড়ে সভ্যতার আদিম স্তরে। নারীকে ততোটা মাত্রায়ই ভক্তি করা হতো, পুরুষ যতোটা হয়ে পড়েছিলো নিজের ভয়ের দাস : পুরুষ নারীকে ভক্তি করতো প্রেমে নয়, ত্রাসে। পুরুষ তার নিয়তি অর্জন করতে পারতো শুধু নারীকে সিংহাসনচ্যুত করে। তারপর থেকে পুরুষ সার্বভৌমরূপে স্বীকার করে শুধু সৃষ্টিশীল শক্তি, আলো, মনন, শৃঙ্খলা প্রভৃতি পুরুষ-নীতিকেই। দেবী মহামাতার পাশে দেখা দেয় আরেকটি দেবতা, পুত্র বা প্রেমিক, যে তখনো ছিলো দেবী মহামাতার অধীনে, কিন্তু সব বৈশিষ্ট্যেই সে দেবী মহামাতার মতো, এবং তার সহচর। সেও প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে এক উর্বরতা নীতির, বৃষরূপে দেখা দেয় মিনোতাউর, নীল নদী উর্বর করে তোলে মিশরের নিম্নাঞ্চল। সে মারা যায় শরতে এবং পুনর্জীবন লাভ করে বসন্তে, যখন তার অবেধ্য কিন্তু সান্ত্বনাহীনভাবে শোকাতুর স্ত্রী-মাতা নিজের শক্তি নিয়োগ করে খুঁজে পায় তার মৃতদেহ এবং পুনর্জীবন দেয় তাকে। এ-যুগলকে আমরা প্রথম আবির্ভূত হতে দেখি ক্রিটে, এবং তারপর দেখতে পাই ভূমধ্যসাগরীয় সমস্ত উপকূলে : মিশরে এটা আইসিস ও হোরাস, ফিনিশিয়ায় আস্তারতে ও অ্যাডোনিস, এশিয়া মাইনরে সিবিলে ও আত্তিস, এবং হেলেনি গ্রিসে এটা রিয়া ও জিউস।
এবং এর পরই সিংহাসনচ্যুত করা হয় মাহামাতাকে। মিশরে, যেখানে নারীর পরিস্থিতি থাকে অসাধারণভাবে অনুকূল, সেখানে নাট, যে হয় আকাশমণ্ডলের প্রতিমূর্তি, এবং আইসিস, উর্বরতার প্রতিমূর্তি, নীলনদের পত্নী এবং ওসিরিস রয়ে যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবী, কিন্তু তবুও সেখানে রা, যে দেবতা সূর্যের আলোর, পৌরুষ শক্তির, সে হয়ে ওঠে পরম প্রধান। ব্যাবিলনে ইশতার হয়ে ওঠে বেল-মার্দুকের পত্নী মাত্র। বেল-মার্দুক সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও সামঞ্জস্যবিধানকারী। সেমিটিদের দেবতাও পুরুষ। যখন সর্বশক্তি নিয়ে দেখা দেয় জিউস, তখন ক্ষমতাহীন হয়ে ওঠে গাইয়া, রিয়া, ও সিবিলে। দিমিতার থাকে একটি দ্বিতীয় মর্যাদার দেবী। বৈদিক দেবতাদের পত্নী আছে, কিন্তু স্বামীদের মতো পুজো পাওয়ার অধিকার তাদের নেই। রোমীয় জুপিটারের সমকক্ষ তো নেই কেউই।
তাই পিতৃতন্ত্রের বিজয় কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিলো না, আর তা প্রচণ্ড কোনো বিপ্লবের ফলও ছিলো না। মানবজাতির সূচনা থেকেই নিজেদের জৈবিক সুবিধা পুরুষকে দিয়েছে নিজেদের সর্বেসর্বা ও সার্বভৌমরূপে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা; তারা এ-অবস্থান কখনো ছেড়ে দেয় নি; তারা একদা তাদের স্বাধীন অস্থিত্বের একটি অংশ ছেড়ে দিয়েছিলো প্রকৃতি ও নারীর কাছে; কিন্তু পরে তারা তা আঁবার অধিকার করে নেয়। অপর-এর ভূমিকা পালনের জন্যে দণ্ডিত নারী এছাড়াও দণ্ডিত হয় শুধু অনিশ্চিত শক্তি ধারণে : দাসী অথবা দেবী, নারী কখনো নিজের ভাগ্য নিজে বেছে নেয় নি। পুরুষ দেবতা সৃষ্টি করে; নারীরা তাদের পুজো করে, বলেছেন ফ্রেজার; পুরুষই ঠিক করে তাদের পরম দেবতা পুরুষ হবে না নারী হবে; পুরুষ নারীর জন্যে যা ঠিক করেছে, নারীর অবস্থা সব সময়ই হয়েছে তা-ই; নারী কখনোই তার নিজের বিধান আরোপ করে নি।
তবে যদি নারীর শক্তির মধ্যে থাকতো উৎপাদনশীল শ্রম, তাহলে হয়তো পুরুষের সাথে নারীও জয়ী হতো প্রকৃতির ওপর; তাহলে মানবপ্রজাতি দেবতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতো পুরুষ ও নারী উভয়েরই মধ্য দিয়ে; কিন্তু নারী নিজের জন্যে হাতিয়ারের প্রতি সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারে নি। এঙ্গেলস নারীর মর্যাদাহানির একটি অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র : একথা বলা যথেষ্ট নয় যে ব্রোঞ্জ ও লোহা আবিষ্কার উৎপাদনের শক্তিগুলোর ভারসাম্য নষ্ট করেছিলো গভীরভাবে এবং এর ফলেই নারী পতিত হয়েছিলো নিম্নাবস্থানে; নারী যে-পীড়ন ভোগ করেছে, তা ব্যাখ্যার জন্যে এনিম্নতার ধারণা যথেষ্ট নয়। নারীর জন্যে যা ছিলো দুর্ভাগ্যজনক, তা হচ্ছে সে শ্রমিকের সহকর্মী না হওয়ার ফলে সে বাদ পড়ে যায় মানবিক মিটজাইন থেকেও। নারী দুর্বল এবং তার উৎপাদন শক্তি কম, এটা তার বাদ পড়া ব্যাখ্যা করতে পারে না; নারী যেহেতু পুরুষের কর্মপদ্ধতি ও চিন্তারীতিতে অংশ নেয় নি, যেহেতু নারী দাসত্বের বন্ধনে রয়ে গেছে জীবনের রহস্যময় প্রক্রিয়ার কাছে, তাই পুরুষ নারীর মধ্যে নিজের মতো কোনো সত্তাকে দেখতে পায় নি। যেহেতু সে গ্রহণ করে নি নারীকে, তার চোখে যেহেতু নারীকে মনে হয়েছে অপর-এর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলে, তাই পুরুষের পক্ষে নারীর পীড়নকারী ছাড়া আর কিছু হয়ে ওঠা সম্ভব হয় নি। পুরুষের ক্ষমতা লাভের ও সম্প্রসারণের ঈলা নারীর অশক্তিকে পরিণত করেছে একটি অভিসম্পাতে।