নারীর মধ্যে বহুবার পুনর্জন্ম নিতো যে-টোটেমি পিতৃপুরুষ, পশু বা বৃক্ষবাসী কারো নামে সে ছিলো এক পুরুষ-নীতি; নারী পিতৃপুরুষের অস্তিত্বকে স্থায়িত্ব দিতো দেহে, কিন্তু তার ভূমিকা ছিলো শুধুই পুষ্টিসাধনের, তা কখনো সৃষ্টিশীল ছিলো না। কোনো এলাকায়ই নারী সৃষ্টি করতো না; সন্তান ও অন্ন দিয়ে সে রক্ষা করতো গোত্রের জীবন, তবে এর বেশি কিছু নয়। সীমাবদ্ধতায় বন্দী হয়ে ধ্বংস হয় নারী, সে পুনর্জন্ম ঘটাতে থাকে শুধু সমাজের স্থিত বৈশিষ্ট্যের, আর আটকে থাকে তাতেই। তখন পুরুষ এগিয়ে যায় সে-সব কর্মকাণ্ডে, যা সমাজকে খুলে দেয় প্রকৃতি ও অন্য মনুষ্যমণ্ডলির দিকে। পুরুষের যোগ্য কাজ ছিলো যুদ্ধ, শিকার, মাছধরা; সে লুণ্ঠন করে সম্পদ নিয়ে এসে দান করতে নিজের গোত্রকে; যুদ্ধ, শিকার, ও মাছধরা বোঝাতা অস্তিত্বের প্রসারণ, অস্তিত্বকে বিশ্বের দিকে প্রসারিত করে দেয়া। পুরুষ একাই থাকতো সীমাতিক্ৰমণতার প্রতিমূর্তি। তখনও তার পৃথিবী-নারীর ওপর সম্পূর্ণ আধিপত্য করার বাস্তব উপায় ছিলো না; তখনও সে পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস করে নি–তবে এর মাঝেই পুরুষের মনে বাসনা জাগে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার।
আমার মতে এ-বাসনার মধ্যেই খুঁজতে হবে বহির্বিবাহ নামক প্রসিদ্ধ প্রথাটির গভীরপ্রাথিত কারণ, যে-প্রথা মাতৃধারার সমাজগুলোতে যা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। পুরুষ যদি জন্মদানে তার ভূমিকা সম্পর্কে অজ্ঞও থাকে, তবু বিয়ে তার জন্যে এক বিশাল গুরুত্বের ব্যাপার : বিয়ের মধ্য দিয়েই সে অর্জন করে পুরুষের মর্যাদা, এবং একখণ্ড জমি হয় তার। গোত্রটির সাথে সে জড়িত তার মায়ের মাধ্যমে, তার মাধ্যমে সে জড়িত তার পূর্বপুরুষদের ও তার সমস্ত কিছুর সাথে; কি তার সমস্ত ঐহিক ভূমিকায়, কর্মে, বিবাহে, সে মুক্তি পেতে চায় এ-বৃত্ত থেকে, সীমাবদ্ধতার ওপর জ্ঞাপন করতে চায় সীমাতিক্ৰমণতা, সে উন্মুক্ত করতে চায় এক ভবিষ্যৎ, যা খুবই ভিন্ন সেঅতীতের থেকে, যার গভীরে লুপ্ত তার মূল। বিভিন্ন সমাজে স্বীকৃত সম্পর্কের রীতি অনুসারে অজাচার নিষিদ্ধকরণ নেয় বিভিন্ন রূপ, তবে আদিম কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত এটা ধারণ করে আছে একই অর্থ : পুরুষ তা অধিকার করতে চায় সে যা নয়, সে তার সাথে মিলন চায় যাকে মনে হয় তার নিজেকে থেকে অপর। সুতরাং স্ত্রী তার স্বামীর মানার অংশী হবে না, তাকে হতে হবে স্বামীর কাছে অপরিচিত, এবং এভাবে তার গোত্রের কাছে অপরিচিত। আদিম বিবাহ অনেক সময় অনুষ্ঠিত হয়, সত্যিকার বা প্রতীকী, অপহরণের মধ্য দিয়ে, এবং নিশ্চিতভাবেই অপরের ওপর যেহিংস্রতা চালানো হয়, তা-ই হচ্ছে ওইজনের বিকল্পতার অতিশয় স্পষ্ট ঘোষণা। বলপ্রয়োগ করে নিজের স্ত্রীকে গ্রহণ করে যোদ্ধা দেখায় যে সে অপরিচিতদের সম্পদ নিজের অধিকারে আনতে এবং জন্মসূত্রে তার জন্যে নির্ধারিত হয়েছে যে-নিয়তি, তার সীমা ভেঙে ফেলতে সমর্থ। বিচিত্র রীতিতে স্ত্রী-ক্রয়–কর দান, সেবা দান–যদিও কম নাটকীয়, তবুও তার তাৎপর্য একই।
অল্প অল্প করে পুরুষ কাজ করতে থাকে তার অভিজ্ঞতা অনুসারে, এবং তার প্রতীকী উপস্থাপনে, যেমন তার বাস্তব জীবনে, যা জয়লাভ করে তা হচ্ছে পুরুষনীতি। চেতনা জয়ী হয় জীবনের ওপর, সীমাতিক্রমণতা জয়ী হয় সীমাবদ্ধতার ওপর, কৌশল জয় লাভ করে ইন্দ্রজালের ওপর, এবং যুক্তি জয় লাভ করে কুসংস্কারের। ওপর। মানুষের ইতিহাসে নারীর অবমূল্যায়ন হয়ে ওঠে একটি আবশ্যক পর্ব, কেননা নারীর মর্যাদা তার সদর্থক মূল্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, প্রতিষ্ঠিত পুরুষের দুর্বলতার ওপর। নারীতে মূর্তি পরিগ্রহ করে প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকর রহস্যগুলো, আর তখনই পুরুষ মুক্তি পায় নারীর অধিকার থেকে, যখন সে নিজেকে মুক্ত করে প্রকৃতি থেকে। লৌহ যুগ থেকে ব্রোঞ্জ যুগে অগ্রগতি তার শ্রমের মাধ্যমে তাকে সমর্থ করে মাটির ওপর তার প্রভুত্ব স্থাপনে ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কৃষক মৃত্তিকার বাধাবিঘ্নের অধীন, বীজের অঙ্কুরোগমের অধীন, ঋতুর অধীন; সে অক্রিয়, সে প্রার্থনা করে, সে প্রতীক্ষা করে; এ-কারণেই একদা টোটেমি প্রেতাত্মারা ভিড় জমিয়েছিলো পুরুষের বিশ্বে; কৃষক তার চারপাশের এ-শক্তিগুলোর চপলতার অধীন। যন্ত্ৰকুশল পুরুষ, এর বিপরীতে, নিজের নকশা অনুসারে তৈরি করে তার যন্ত্রপাতি; তার পরিকল্পনা অনুসারে তার হাত দিয়ে একে সে গঠন করে; অক্রিয় প্রকৃতির মুখখামুখি হয়ে সে জয় করে প্রকৃতির প্রতিরোধ এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে তার সার্বভৌম ইচ্ছা। যদি সে নেহাইয়ের ওপর তার আঘাত দ্রুততর করে, তাহলে কম সময়ের মধ্যে সে তৈরি করে তার হাতিয়ার, আর সেখানে কোনো কিছুই শস্যের পেকে ওঠাকে ত্বরান্বিত করতে পারে না। সে যা তৈরি করছে, তা তৈরিতে সে নিজের দায়িত্ব বুঝতে পারে : তার দক্ষতায় বা অপটুতায় এটি তৈরি হবে বা ভাঙবে; সতর্ক, চতুর, সে তার দক্ষতাকে এমন এক উৎকর্ষের স্তরে নিয়ে যায় যে সে তাতে গর্ববোধ করে : দেবতাদের অনুগ্রহের ওপর তার সাফল্য নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে নিজের ওপর। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে সে তার সহচরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে, সে তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়। এবং যদিও সে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে কিছুটা জায়গা দেয়, তবু সে বোধ করে যে যথাযথ কৌশল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ; অতীন্দ্রিয় মূল্যবোধ গ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান এবং বাস্তব স্বার্থগুলো প্রথম স্থান। সে দেবতাদের থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয়। তবে সে তাদের নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যেমন সে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনে তাদের থেকে; সে তাদের হাতে ছেড়ে দেয় অলিম্পীয় স্বর্গের ভার এবং পার্থিব এলাকাটি রাখে নিজের হাতে। মহাদেবতা প্যান ম্রিয়মাণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন বেজে ওঠে প্রথম হাতুড়ি ঘায়ের শব্দ এবং শুরু হয় পুরুষের রাজত্ব।