পুরুষের কাছে সব সময়ই সহকর্মী হচ্ছে আরেকজন পুরুষ, আরেকজনও তারই মতো, যার সাথে গড়ে ওঠে তার পারস্পরিক সম্পর্ক। সমাজের মধ্যে এক রূপে বা অন্য রূপে গড়ে ওঠে যে-দ্বৈততা, তাতে এক দল পুরুষ বিপক্ষে যায় আরেক দল পুরুষের; নারীরা হয় তাদের সম্পত্তির অংশ, যা থাকে দু-দল পুরুষেরই দখলে এবং যা তাদের মধ্যে বিনিময়ের একটি মাধ্যম। নারী কখনোই নিজের পক্ষ থেকে পুরুষের বিপরীতে একটি পৃথক দল গড়ে তোলে নি। তারা কখনোই পুরুষের সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ ও স্বায়ত্তশাসিত সম্পর্কে আসে নি। বিয়ের মধ্যে থাকে যে পারস্পরিক বন্ধন, তা পুরুষেরা ও নারীরা স্থাপন করে না, বরং নারীর মাধ্যমে তা স্থাপিত হয় পুরুষদের ও পুরুষদের মধ্যে, নারীরা তাতে থাকে শুধু প্রধান ব্যাপার, বলেছেন লেভি-স্ট্রাউস। নারীটি যে-সমাজের অন্তর্ভুক্ত, তার বংশধারা নির্দেশের রীতি যাই হোক-না-কোনো, তাতে নারীর প্রকৃত অবস্থার কোনো বদল ঘটে না; তা মাতৃধারাই হোক, বা পিতধারাই হোক, বা উভয়ধারাই হোক, বা অভিন্ন ধারাই হোক, সে সব সময়ই থাকে পুরুষদের অভিভাবকত্বে। একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে বিয়ের পর নারী থাকবে কার কর্তৃত্বে, পিতার না বয়োজ্যষ্ঠ ভ্রাতার–এমনকি এ-কর্তৃত্ব সম্পসারিত হতে পারে নারীর সন্তানদের পর্যন্ত না কি সে থাকবে তার স্বামীর কর্তৃত্বে। নারী, নিজের দিক দিয়ে, কখনোই তার ধারার প্রতীকের থেকে বেশি কিছু নয়… মাতৃধারার বংশধারা হচ্ছে নারীটির পিতা বা ভ্রাতার অভিভাবকত্ব, যা পেছনের দিকে সম্প্রসারিত হয়ে গিয়ে পৌঁছে ভাইয়ের গ্রামে, এটা লেভি-স্ট্রাউস থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি। সে নিতান্তই অভিভাবকত্বের মধ্যস্থতাকারী, সে অভিভাবক নয়। সত্য হচ্ছে বংশধারার রীতি অনুসারে সম্পর্ক নির্ণীত হয় দুটি দলের পুরুষের মধ্যে, দুটি লিঙ্গের মধ্যে নয়।
বাস্তবিকভাবে নারীর প্রকৃত অবস্থা এক বা অন্য ধরনের কর্তৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত নয়। এমন হতে পারে যে মাতৃধারার পদ্ধতিতে তার অবস্থান অতি উচ্চে; তবু আমাদের সতর্কতার সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে কোনো গোত্রের প্রধান বা রাণীরূপে কোনো নারী থাকলেই বোঝায় না যে সেখানে নারীরাই সার্বভৌম : মহান ক্যাথেরিনের সিংহাসন আরোহণের ফলে রাশিয়ার কৃষক নারীর ভাগ্যের কোনো বদল ঘটে নি; এবং এমন পরিস্থিতিতে নারী প্রায়ই বাস করে শোচনীয় অবস্থায়। উপরন্তু, এমন ঘটনা খুবই দুর্লভ যেখানে স্ত্রীটি বাস করে তার গোত্রের সঙ্গে, আর তার স্বামীকে দেয়া হয় তার সাথে স্বল্পকালীন, এমনকি সংগোপন সাক্ষাতের অনুমতি। অধিকাংশ সময়ই সে যায় স্বামীর করার জন্যে, এটি এমন ঘটনা যা পুরুষের প্রাধান্য প্রদর্শনের জন্যে যথেষ্ট।
অধিকতর ব্যাপক পরিবর্তনমূলক ব্যবস্থায় পরস্পরসংবদ্ধ হয় দু-রকম কর্তৃত্ব, একটি ধর্ম, আর অপরটি ওঠে পেশা ও ভূমিচাষ ভিত্তি করে। ঐহিক সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের আছে এক বিশাল সামাজিক গুরুত্ব, এবং দাম্পত্য পরিবার, ধর্মীয় তাৎপর্যহীন হয়ে পড়লেও, মানবিক স্তরে যাপন করে এক তীব্র জীবন। এমনকি যে-সব জনগোষ্ঠিতে বিরাজ করে মহাযৌনস্বাধীনতা, সেখানেও যে-নারী পৃথিবীতে একটি শিশু আনে, তাকে বিবাহিত হওয়া সঙ্গত; সে একলা নিজের সন্তান নিয়ে একটি দল গঠনে অসমর্থ। এবং তার ভাইয়ের ধর্মীয় তত্ত্বাবধান অপ্রতুল : একটি স্বামীর উপস্থিতি দরকার। তার সন্তানের ব্যাপারে পুরুষটির প্রায়ই থাকে গুরুদায়িত্ব। তারা তার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয় না, তবুও তাকেই তাদের ভরণপোষণ ও লালনপালন করতে হয়। স্বামী ও স্ত্রীর, পিতা ও পুত্রের মধ্যে স্থাপিত হয় সঙ্গমের, কর্মের, অভিন্ন স্বার্থের, প্রীতির বন্ধন।
অতীন্দ্রিয় ও আর্থনীতিক বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য একটি অস্থির ব্যাপার। পুরুষ প্রায় সর্বদাই তার ভ্রাতপুত্রের থেকে নিজের পুত্রের সাথে অনেক বেশি দৃঢ়ভাবে লগ্ন থাকে; যখন সময় আসে সে নিজেকে পিতা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই বেশি পছন্দ করে। এ-কারণেই বিবর্তন যখন পুরুষকে আত্মসচেতনতা ও নিজের ইচ্ছে প্রয়োগের পর্যায়ে নিয়ে আসে, তখন প্রতিটি সমাজ পিতৃতান্ত্রিক রূপ ধারণ করতে থাকে। তবে একথাটিকে গুরুত্ব দিতে হবে যে এমনকি যখন সে বিহ্বল ছিলো জীবনের, প্রকৃতির, ও নারীর রহস্যের মুখখামুখি, তখনও সে কখনো শক্তিহীন ছিলো না; যখন, নারীর ভয়ঙ্কর ইন্দ্রজালে সন্ত্রস্ত হয়ে, সে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করে অপরিহার্যরূপে, তখনও সেই নারীকে প্রতিষ্ঠিত করে এই রূপে এবং এভাবে এ-স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে সে-ই কাজ করে অপরিহার্যরূপে। নারীর উর্বরতাশক্তি সত্ত্বেও পুরুষই থেকেছে নারীর প্রভু, যেমন পুরুষই মালিক উর্বর ভূমির; যার ঐন্দ্রজালিক উর্বরতার সে প্রতিমূর্তি, সে-প্রকৃতির মতো পুরুষের অধীনে, অধিকারে, শশাষণের মধ্যে থাকাই নারীর নিয়তি। পুরুষের কাছে সে পায় যে-মর্যাদা, তা তাকে দিয়েছে পুরুষই; পুরুষ প্রণাম করে অপরকে, উপাসনা করে দেবী মাতার। তবে এভাবে নারীকে যতো শক্তিশালীই বলেই মনে হোক, সে এটা লাভ করেছে শুধু পুরুষের মনের ভাবনার মধ্য দিয়েই।
পুরুষ যতো মূর্তি তৈরি করেছে, সেগুলোকে যতোই করা মনে হোক-না-কোননা, আসলে সেগুলো পুরুষেরই অধীন; এবং এ-কারণে সেগুলোকে ধ্বংস করার শক্তিও সব সময় রয়েছে তার আয়ত্তে। আদিম সমাজে ওই অধীনতা স্বীকার করা হয় না এবং খোলাখুলিভাবে প্রয়োগ করা হয় না, তবে ঘটনার প্রকৃতি অনুসারে এর আছে অব্যবহিত অস্তিত্ব; এবং পুরুষ যখনই অর্জন করবে স্পষ্টতর আত্মসচেতনতা, যখনই সে সাহস পাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ও প্রতিরোধ করতে, তখনই প্রয়োগ করা হবে একে।