এসব বিশ্বাসের মূল খুবই গভীরে প্রোথিত এবং আজো টিকে আছে ভারতি, অস্ট্রেলীয়, ও পলিনেশীয় অনেক গোত্রের মধ্যে। অনেক গোত্রে বন্ধ্যা নারীকে ভয়ঙ্কর মনে করা হয় বাগানের জনে, অনেক গোত্রে মনে করা হয় যে ফলন হবে প্রচুর যদি ফসল কাটে গর্ভবতী নারী; আগে ভারতে রাতের বেলা নগ্ন নারীরা জমির চারদিকে লাঙল চালাতো ইত্যাদি। এক উপবিষ্ট অস্তিত্বের মধ্যে বন্দী করে মাতৃত্ব ধ্বংস করে নারীকে; তাই এটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে যে যখন সে থাকে চুলোর ধারে তখন পুরুষ শিকার করে, মাছ ধরে, এবং যুদ্ধ করে। আদিম মানুষদের উদ ছিলো ছোটো, সেগুলোর অবস্থান ছিলো গ্রামের সীমার মধ্যেই; এবং তাদের কৃষিকাজ ছিলো একটা গৃহস্থালির কাজ; এবং প্রস্তুর যুগের হাতিয়ার ব্যবহারেো খুব বেশি শক্তির দরকার পড়তো না। অর্থনীতি ও ধর্ম কৃষিকাজের ভার ছেড়ে দিয়েছিলো নারীর হাতে। যখন গার্হস্থ্যশিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে, তাও হয় তাদের জন্যে দুর্ভাগ্য : তারা মাদুর বোনে ও কাঁথা সেলাই করে এবং বানায় হাঁড়িপাতিল। তাদের মধ্য দিয়েই গোত্রের জীবন সংরক্ষিত ও সম্প্রসারিত হতো; সন্তান, পশু, শস্য, হাঁড়িপাতিল, দলের সব ধরনের সমৃদ্ধি নির্ভর করতে তাদের শ্রম ও ঐন্দ্রজালিক শক্তির ওপর তারা ছিলো সমাজের আত্মা। এ-শক্তি পুরুষের মনে জাগাতো ভয়মেশানো ভক্তি, যা প্রতিফলিত হতো তাদের উপাসনায়। সমগ্র বিরুদ্ধ প্রকৃতির সারসংক্ষেপ ঘটেছিলো নারীতে।
যেমন ইতিমধ্যেই আমি বলেছি, পুরুষ কখনো অপর-এর কথা না ভেবে নিজের সম্পর্কে ভাবে না; সে বিশ্বকে দেখে দ্বৈততার প্রতীকে, যা প্রথমত যৌন ধরনের নয়। কিন্তু পুরুষের থেকে ভিন্ন হয়ে, যে-পুরুষ নিজেকে নির্দেশ করে পুরুষ বলেই, স্বাভাবিকভাবেই নারীকে নির্দেশ করা হয় অপর বলে; অপর হচ্ছে নারী। যখন নারীর ভূমিকা বৃদ্ধি পায়, তখন সে পুরোপুরিভাবে নির্দেশ করে অপর-এর এলাকা। তারপর দেখা দিতে থাকে সে-দেবীরা, যাদের মধ্য দিয়ে পুজো করা হয় উর্বরতার ধারণাকে। সুসায় পাওয়া গেছে মহাদেবীর, মহামাতার আদিতম মূর্তি, যার বস্ত্র দীর্ঘ এবং কেশবিন্যাস উচ্চ, অন্যান্য মূর্তিতে যাকে আমরা দেখতে পাই মিনারের মুকুটশোভিত। ক্রিটে খননকার্যের ফলে এমন কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গেছে। কখনো কখনো সে স্কুল ও অবনত, কখনো কখনো তন্বী ও দণ্ডায়মান, কখনো বস্ত্রপরিহিত এবং প্রায়ই নগ্ন, তার দুই বাহু চেপে আছে তার স্ফীত স্তনযুগলের নিচে। সে স্বর্গের রাণী, তার প্রতীক কপোত; সে নরকেরও সম্রাজ্ঞী, যখন সে হামাগুড়ি দিয়ে চলে তখন সাপ তার প্রতীক। সে আবির্ভূত হয় পর্বতে ও অরণ্যে, সমুদ্রে, ঝরনাধারায়। সবখানেই সে সৃষ্টি করে জীবন; যদিও সে হত্যা করে, তবু সে আবার জীবন দেয় মৃতকে। চপলা, বিলাসিনী, প্রকৃতির মতো নির্মম, একই সাথে প্রসন্ন ও ভয়ঙ্করী সে রাজত্ব করে সমগ্র অ্যাজিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, ফ্রিজিয়া, সিরিয়া, আনাতোলিয়ায়, সমগ্র পশ্চিম এশিয়ায়। ব্যাবিলনিয়ায় তাকে বলা হতো ইশতার, সেমেটীয়রা বলতো আস্তারতে, এবং গ্রিকরা বলতো গাইয়া, বা সিবিলে। মিশরে তাকে আমরা দেখতে পাই আইসিস রূপে। পুরুষ দেবতারা ছিলো তার অধীনে।
সুদূর স্বর্গ ও নরকের পরম দেবীপ্রতিমা, নারী সব পবিত্র সত্তার মতোই মর্ত্যে পরিবৃত ছিলো ট্যাবুতে, সে নিজেই ট্যাবু; সে ধারণ করতো যে-শক্তি, তারই জন্যে তাকে দেখা হতো এক ঐন্দ্রজালিক, অভিচারিণীরূপে। প্রার্থনায় তার আবাহন করা হতো, কখনো সে হয়ে ওঠে যাজিকা, যেমন হতে প্রাচীন কেল্টদের ড্রইডদের মধ্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে অংশ নেয় গোত্রীয় শাসনকর্মে, এমন কি হয় একক শাসক। এ-সুদূর যুগগুলো আমাদের জন্যে কোনো সাহিত্য রেখে যায় নি। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের মহাপর্বগুলো তাদের পুরাণ, কীর্তিস্তম্ভ, ও ঐতিহ্যধারার মধ্যে সংরক্ষণ করেছে সেসময়ের স্মৃতি, যখন খুবই মহিমান্বিত অবস্থান অধিকার করে ছিলো নারীরা। নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে, ঋগ্বেদ-এর যুগের উঁচু অবস্থান থেকে নারীর পতন ঘটতে থাকে ব্রাহ্মণ্য যুগে, এবং ঋগ্বেদ-এর যুগে পতন ঘটেছিলো পূর্ববর্তী আদম স্তর থেকে। ইসলামপূর্ব যুগে বেদুইন নারীরা উপভোগ করতে কোরানে প্রদত্ত মর্যাদার থেকে অনেক উচ্চতর মর্যাদা। নিওবি, মিডিয়ার মহামূর্তিগুলো এমন এক যুগের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, যখন মাতারা গর্ববোধ করতো তাদে্র সন্তানদের নিয়ে, মনে করতো সন্তানেরা একান্তভাবে তাদেরই সম্পদ। এবং হোমারের কাব্যে অ্যান্ড্রোমাকি ও হেকিউবার ছিলো এমন গুরুত্ব, যা ধ্রুপদী গ্রিস আর নারীকে দেয় নি।
এসব তথ্য এমন অনুমানের দিকে এগিয়ে দেয় যে আদিম কালে সত্যিই ছিলো নারীরাজত্বের একটা যুগ : মাতৃতন্ত্র। বাখোফেনের প্রস্তাবিত এ-প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন এঙ্গেলস, এবং মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণকে তিনি বলেছিলেন নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়। তবে নারীর সে-স্বর্ণযুগ আসলে একটি কিংবদন্তি মাত্র। একথা বলা যে নারী ছিলো অপর, এর অর্থ হচ্ছে দুলিঙ্গের মধ্যে কখনোই পারস্পরিক সম্পর্ক বিরাজ করে নি; ভূমি, মাতা, দেবী–
পুরুষের চোখে সে কোনো সঙ্গী প্রাণী ছিলো না; তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত ছিলো মানবিক এলাকার বাইরে, সুতরাং সে ছিলো ওই এলাকার বাইরের। সমাজ চিরকালই থেকেছে পুরুষের; রাজনীতিক শক্তি চিরকালই থেকেছে পুরুষের হাতে। সর্বসাধারণ বা সামাজিক কর্তৃত্ব সর্বদাই থাকে পুরুষের অধিকারে, আদিম সমাজ বিষয়ক এক গবেষণার শেষ দিকে ঘোষণা করেছেন লেভি-স্ট্রাউস।