সংস্থা ও আইন দেখা দেয় যখন যাযাবররা বসতি স্থাপন করে হয়ে ওঠে কৃষিজীবী। পুরুষকে আর বিরূপ প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় না; বিশ্বের ওপর সে যে-রূপ চাপিয়ে দিতে চায়, তার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করে ভাবতে শুরু করে বিশ্ব ও নিজের সম্পর্কে। এসময়ে লৈঙ্গিক পার্থক্য প্রতিফলিত হয় মানবগোষ্ঠির সংগঠনে, এবং এটি ধারণ করে এক বিশেষ রূপ। কৃষিসমাজে নারীকে মাঝেমাঝে ভূষিত করা হতো এক অসাধারণ মর্যাদায়। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় সন্তান যে-নতুন গুরুত্ব অর্জন করে, মূলত তার সাহায্যেই ব্যাখ্যা করতে হবে এ-মর্যাদাকে। বিশেষ এলাকায় বসতি স্থাপন করে পুরুষ তার ওপর প্রতিষ্ঠা করে নিজের মালিকানা, এবং সম্পত্তি দেখা দেয় যৌথরূপে। সম্পত্তির জন্যে দরকার পড়ে তার মালিকের থাকবে উত্তরপুরুষ, এবং মাতৃত্ব হয়ে ওঠে এক পবিত্র ভূমিকা।
বহু গোত্র বাস করতো সংঘের অধীনে, তবে এর অর্থ এ নয় যে নারীরা থাকতো সাধারণভাবে সব পুরুষের অধিকারে–এখন আর মোটেই মনে করা হয় না যে অবাধ যৌনতা কখনো ছিলো সাধারণ রীতি–তবে পুরুষ ও নারী ধর্মীয়, সামাজিক, ও আর্থনীতিক অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুধু একটি দল হিশেবে : তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ছিলো নিতান্তই এক জৈবিক সত্য। বিবাহ–একপতিপত্নীক, বহুপত্নীক, বা বহুস্বামীক–তার রূপ যা-ই হোক-না-কেননা, ছিলো একটা ঐহিক আকস্মিকতা, এটা কোনো অতীন্দ্রিয় বন্ধন সৃষ্টি করতো না। এটা স্ত্রীটিকে কোনো দাসত্ববন্ধনে জড়াতো না, কেননা সে তখনো যুক্ত থাকতো তার নিজের গোত্রের সাথে।
এখন, অনেক আদিম মানবগোষ্ঠিই অজ্ঞ ছিলো সন্তান জন্মদানে পিতার ভূমিকা সম্বন্ধে (অনেক ক্ষেত্রে একে আজো সত্য বলে মনে হয়); সন্তানদের তারা মনে করতো তাদেরই পিতৃপুরুষদের প্রেতাত্মার পুনর্জন্মগ্রহণ বলে, যে-প্রেতাত্মারা বাস করতো কোনো গাছে বা প্রস্তরে, কোনো পবিত্র স্থানে, এবং নেমে এসে ঢুকতে নারীদের শরীরে। অনেক সময় মনে করা হতো যে এ-অনুপ্রবেশ যাতে সহজ হয়, তার জন্যে নারীদের কুমারী থাকা ঠিক হবে না; তবে অন্যান্য জনগোষ্ঠি বিশ্বাস করতো যে এটা নাক দিয়ে বা মুখ দিয়েও ঘটতে পারে। তা যা-ই হোক, এতে সতীত্বমোচন ছিলো গৌণ, এবং অতীন্দ্রিয় প্রকৃতির কারণে খুব কম সময়ই এটা ছিলো স্বামীর বিশেষাধিকার।
তবে সন্তান জন্মদানের জন্যে মা ছিলো সুস্পষ্টভাবে আবশ্যক; মা-ই ছিলো সেজন, যে নিজ দেহের ভেতরে জীবাণুটিকে রক্ষা করতে ও তার পুষ্টি যোগাতো, সুতরাং তার মাধ্যমেই গোত্রের জীবন বিস্তার লাভ করতে দৃশ্যমান বিশ্বে। এভাবে সে পালন করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অধিকাংশ সময়ই শিশুরা অন্তর্ভুক্ত হতে তাদের মায়ের গোত্রে, ধারণ করতো গোত্রের নাম, এবং পেন্সে গোত্রের অধিকার ও সুযোগসুবিধা, বিশেষ করে গোত্রের অধিকারে যে-জমি থাকতো, তা ব্যবহারের অধিকার। সংঘের সম্পত্তি উত্তরাধিকারীরা পেতো নারীদের কাছ থেকে : নারীদের মাধ্যমে ভূমি ও শস্যের মালিকানা নিশ্চিত করা হতো গোত্রের সদস্যদের মধ্যে, এবং বিপরীতভাবে এ-সদস্যরা তাদের মায়েদের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো এই বা ওই এলাকার জন্যে। আমরা তাই অনুমান করতে পারি যে এক অতীন্দ্রিয় অর্থে মৃত্তিকার মালিক ছিলো নারীরা : ভূমি ও তার শস্যের ওপর নারীদের ছিলো অধিকার, যা ছিলো যুগপৎ ধর্মীয় ও আইনগত। নারী ও ভূমির মধ্যে বন্ধন ছিলো মালিকানার থেকেও ঘনিষ্ঠ, কেননা মাতৃধারার ব্যবস্থায় বৈশিষ্ট্যই ছিলো নারীকে মৃত্তিকার সাথে সত্যিকারভাবে সমীভূত করা; উভয়ের মধ্যেই জীবনের চিরস্থায়িত্ব–যা ছিলো মূলত প্রজনন–লাভ করা হতো তার ব্যক্তিক মূর্তপ্রকাশদের, অবতারদের জন্মদানের মাধ্যমে।
যাযাবরদের কাছে সন্তানের জন্মকে নিতান্ত আকস্মিক ঘটনার বেশি কিছু মনে হতো না, এবং মৃত্তিকার সম্পদের কথা ছিলো তাদের অজানা; কিন্তু কৃষিজীবী বিস্মিত হতে উৎপাদনশীলতার রহস্যে, যা দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠতো তার হলরেখায় ও মাতার শরীরের ভেতরে : সে বুঝতে পারতো সেও জন্মেছে ওই পশু ও শস্যের মতো, সে চাইতো তার গোত্র জন্ম দিক আরো পুরুষ, যারা তার গোত্রকে স্থায়িত্ব দেয়ার সাথে ভূমির উর্বরতাকেও দেবে স্থায়িত্ব; প্রকৃতিকে তার মনে হতো মায়ের মতো : ভূমি হচ্ছে নারী এবং নারীর ভেতরে বাস করে সে-একই দুর্বোধ্য শক্তিগুলো, যেগুলো বাস করে মাটির গভীরে। এ-কারণেই কৃষিকাজের ভার অনেকটা দেয়া হতো নারীর ওপর; পিতৃপুরুষদের প্রেতাত্মাদের যে ডেকে আনতে পারে নিজের শরীরের ভেতরে, তার সে-শক্তিও থাকার কথা যা দিয়ে সে রোপন করা জমিতে ফলাবে ফল ও শস্য। উভয় ক্ষেত্রেই কোনো সৃষ্টিশীল কাজের ব্যাপার ছিলো না, ছিলো ইন্দ্রজালের ব্যাপার। এ-পর্যায়ে শুধু মাটির শস্যরাজি সংগ্রহের মধ্যে পুরুষ আর নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি, তবে সে তখনো নিজের শক্তিকে বুঝতে পারে নি। নিজেকে অক্রিয় বোধ করে, যেপ্রকৃতি নির্বিচারে ঘটাতে জীবন ও মৃত্যু, তার ওপর নির্ভরশীল থেকে দ্বিধান্বিতভাবে সে দাঁড়িয়ে ছিলো কৌশল ও যাদুর মধ্যে। একথা সত্য, কম বা বেশি স্পষ্টভাবে সে বুঝতে পারে যৌনকর্মের এবং যে-সব কৌশলে সে ভূমিকে আবাদযোগ্য করে তুলছে, তার কার্যকারিতা। এ-সত্ত্বেও সন্তান ও শস্যকে দেবতাদের দান বলেই মনে করা হতো এবং বিশ্বাস করা হতো যে নারীর শরীর থেকে বয়ে আসা রহস্যময় প্রবাহগুলো এ-বিশ্বে নিয়ে আসে জীবনের রহস্যময় উৎসে নিহিত সম্পদরাশি।