আদিমানুষের কর্মের ছিলো আরেকটি মাত্রা, যা তাকে দিয়েছে পরম গৌরব : অধিকাংশ সময়ই এটা ছিলো ভয়ঙ্কর। রক্ত যদি হতো কোনো পুষ্টিকর তরল পদার্থ, তাহলে তা দুধের থেকে বেশি মূল্য পেতো না; তবে শিকারী কোনো কশাই ছিলো না, কেননা বন্যপশুর সাথে লড়াইয়ে তার ছিলো ভয়ঙ্কর ঝুঁকি। নিজের গোত্রের, যার সে ছিলো অন্তর্ভুক্ত, তার মর্যাদা বাড়ানোর জন্যে যোদ্ধা বিপন্ন করতো নিজের জীবন। এবং এর মধ্যে সে নাটকীয়ভাবে প্রমাণ করতে যে পুরুষের জন্যে জীবনই পরম মূল্যবান নয়, বরং এর বিপরীতে একে ব্যবহার করতে হবে সে সব লক্ষ্য সাধনে, যা জীবনের থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নিকৃষ্টতম যে-অভিসম্পাতে অতিশপ্ত হয় নারী, তা হচ্ছে সে পরিত্যক্ত হয় যুদ্ধের সমতুল্য এসব হঠাৎ আক্রমণে অংশগ্রহণ থেকে। কেননা জীবন সৃষ্টি করে নয়, বরং বিপন্ন করে পুরুষ উন্নীত হয় পশুর উর্ধ্বে; এ-কারণেই মানবমণ্ডলির মধ্যে সে-লিঙ্গকেই দেয়া হয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব, যে-লিঙ্গ জন্ম দেয় না, বরং হত্যা করে।
এখানেই আমরা পাচ্ছি পুরো রহস্যের চাবি। জৈবিক স্তরে কোনো প্রজাতি টিকে থাকে শুধু নিজেকে নতুনভাবে সৃষ্টি করে; কিন্তু এ-সৃষ্টি শুধু একই জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটায় অধিকতর ব্যক্তিত্ব মধ্যে। কিন্তু পুরুষ জীবনের পুনরাবৃত্তি নিশ্চিত করে যখন সে অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে সীমাতিক্রমণ করে যায় জীবনের; এ-সীমাতিক্ৰমণ দিয়ে সে সৃষ্টি করে এমন মূল্যবোধ যা হরণ করে বিশুদ্ধ পুনরাবৃত্তির সমস্ত মূল্য। পশুর মধ্যে পুরুষটির স্বাধীনতা ও ক্রিয়াকলাপের বৈচিত্র্য সম্পূর্ণ নিরর্থক, কেননা তাতে কোনো লক্ষ্য জড়িত নেই। নিজের প্রজাতির প্রতি দায়িত্ব পালন ছাড়া সে আর যা কিছু করে, তার সবই তুচ্ছ। আর সেখানে মানব পুরুষ নিজের প্রজাতির প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বদলে দেয় পৃথিবীর মুখমণ্ডল, সে নতুন যন্ত্রপাতি সৃষ্টি করে, সে উদ্ভাবন করে, সে গঠন করে ভবিষ্যতের রূপ। পুরুষ নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পায় নারীর নিজের সহযোগিতার সমর্থন। কেননা নারী নিজেও এক অস্তিত্বশীল, সেও বোধ করে পেরিয়ে যাওয়ার প্রবর্তনা, এবং তার লক্ষ্য শুধু নিতান্তই পুনরাবৃত্তি করা। নয়, বরং একটি ভিন্ন ভবিষ্যতের দিকে সীমাতিক্ৰমণ–অন্তরের অন্তস্তলে নারী বোধ করে পুরুষের দাম্ভিকতার নিশ্চিত প্রমাণ। সে পুরুষের সাথে যোগ দেয় সে-সব উৎসবে, যা উদযাপন করে পুরুষের সাফল্য ও বিজয়। নারীর দুর্ভাগ্য সে জীবনের পুনরাবৃত্তির জন্যে জৈবিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত, যদিও তার মতেই জীবন নিজের মধ্যে বহন করে না জীবনলাভের কারণ, যে-কারণগুলো জীবনের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রভু ও দাসের সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করার জন্যে যে-সব যুক্তি দিয়েছেন হেগেল, সেগুলো বেশি ভালোভাবে কাজ করে পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে। সত্য হচ্ছে যে নারী কখনো পুরুষের মূল্যবোধের বিপরীতে সৃষ্টি করে নি নারীর মূল্যবোধ; পুরুষের সুযোগসুবিধা সংরক্ষণের জন্যে পুরুষই উদ্ভাবন করেছে ওই বিচ্যুতি। পুরুষ সৃষ্টি করেছে নারীর জন্যে এক এলাকা–জীবনের রাজ্য, সীমাবদ্ধতার রাজ্য–নারীকে সেখানে বন্দী করে রাখার জন্যে। কিন্তু লিঙ্গনিরপেক্ষভাবেই প্রতিটি অস্তিত্বশীল চায় সীমাতিক্রমণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে নারীদের বশ্যতাই হচ্ছে এবিবৃতির প্রমাণ। পুরুষ যে-অধিকারে অস্তিত্বশীল হয়েছে, সে-একই অধিকারে আজ নারীরা দাবি করে অস্তিত্বশীল হিশেবে নিজেদের স্বীকৃতি এবং অস্তিত্বকে অধীন করতে চায় না জীবনের, মানবসত্তাকে অধীন করতে চায় না তার পাশবিকতার।
অস্তিত্ববাদী পরিপ্রেক্ষিত আমাদের বুঝতে সমর্থ করেছে কীভাবে আদিম যাযাবরদের জৈবিক ও আর্থনীতিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলো পুরুষাধিপত্য। স্ত্রীলিঙ্গ, পুংলিঙ্গের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে, তার প্রজাতির শিকার, আর মানব জাতি সব সময়ই চেষ্টা করেছে তার বিশেষ নিয়তি থেকে মুক্তি পাওয়ার। জীবনসংরক্ষণ পুরুষের জন্যে হয়েছে একটি সক্রিয় কর্ম এবং হাতিয়ার আবিষ্কারের মাধ্যমে একটি কর্ম পরিকল্পনা; কিন্তু মাতৃত্বের মধ্যে নারী, পশুর মতোই দৃঢ়ভাবে বাঁধা রয়েছে তার দেহের সাথে। পুরুষ চেয়েছে কালপরম্পরায় নিজেকে শুধু পুনরাবৃত্ত না করতে : চেয়েছে বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভবিষ্যত গড়তে। পুরুষের কর্মকাণ্ড মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে গিয়ে অস্তিত্বকেই একটি মূল্যবোধে পরিণত করেছে; এ-কর্মকাণ্ড আধিপত্য বিস্তার করেছে জীবনের বিভ্রান্ত শক্তিগুলোর ওপর; এটাই পরাভূত করেছে প্রকৃতি ও নারীকে।
ভূমির আদিকৃষকেরা
প্রথম খণ্ড । ভাগ ২ – ইতিহাস । পরিচ্ছেদ ২
এইমাত্র আমরা দেখেছি যে আদিম যাযাবরদের মধ্যে নারীর ভাগ্য ছিলো খুবই কঠিন, এবং কোনো সন্দেহ নেই যে-নিষ্ঠুর অসুবিধাগুলো বিকল করে রেখেছিলো নারীকে, সেগুলো দূর করার কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয় নি। তবে পরে পিতৃসুলভ স্বৈরাচারের উদ্যোগে বলপ্রয়োগ করে নারীকে যেমন পীড়ন করা হয়েছে, তেমন পীড়নও করা হয় নি। কোনো সংস্থা দূর করে নি দু-লিঙ্গের অসাম্য, আসলে কোনো সংস্থাই ছিলো না–ছিলো না সম্পত্তি, ছিলো না উত্তরাধিকার, ছিলো না আইন। ধর্ম ছিলো ক্লীব : উপাসনা করা হতো কোনো অলিঙ্গ টোটেমের।