এটা চিরকালই পুরুষের বিশ্ব; এবং এ-ঘটনা ব্যাখ্যার জন্যে যে-সব কারণ প্রস্তাব করা হয়েছে এ-পর্যন্ত, তার কোনোটিই যথেষ্ট নয়। তবে লৈঙ্গিক স্তরক্ৰম কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তা আমরা বুঝতে পারবো যদি অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে বিচার করি প্রাগৈতিহাসিক গবেষণা ও জাতিবিকাশতত্ত্বের তথ্যগুলো। আগেই আমি বলেছি যখন মানুষের দুটি দল একত্রে থাকে তখন একটি চায় অপরটির ওপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে। যদি উভয়েরই থাকে এ-চাপ প্রতিরোধের শক্তি, তাহলে তাদের মধ্যে স্থাপিত হয় পারস্পরিক সম্পর্ক, কখনো শত্রুতার, কখনো মিত্রতার, সব সময়ই থাকে এক উত্তেজনার অবস্থা। যদি একটি কোনো উপায়ে লাভ করে বিশেষ সুযোগ, পায় কিছু সুবিধা, তাহলে সেটিই আধিপত্য করে অপরটির ওপর, এবং চেষ্টা করে তাকে অধীনে রাখতে। তাই বোঝা যায় পুরুষ চাইবে নারীর ওপর আধিপত্য করতে; কিন্তু কী সুবিধা তাকে সাহায্য করেছে নিজের ইচ্ছে বাস্তবায়নে?
মানবজাতিবিদেরা মানবসমাজের আদিম রূপের যে-সব বিবরণ দিয়েছেন, সেগুলো পরস্পরবিরোধী। প্রাককৃষি পর্বে নারীর পরিস্থিতি কী ছিলো, সে-সম্পর্কে ধারণা করা বিশেষভাবেই কঠিন। নারীকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো, এবং বোেঝা বইতে হতো নারীকেই। নারীকে এ-কাজের ভার দেয়া হতো হয়তো এ-কারণে যে দুর্গম পথে চলার সময় আক্রমণকারী পশু বা মানুষের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে পুরুষকে মুক্ত রাখতে হতো তার হাত; তার ভূমিকা ছিলো অধিকতর ভয়ঙ্কর এবং এর জন্যে দরকার হতো বেশি শক্তি। তবে এও দেখা গেছে অনেক সময় অনেক নারী হতো শক্তসমর্থ, এবং তারা অংশ নিতে যোদ্ধাদের অভিযানে। নারী যে পুরুষের মতোই হিংস্র ও নিষ্ঠুরভাবে যুদ্ধবিগ্রহে অংশ নিতো, তা বোঝার জন্যে হিরোদোতাসের গল্প ও ডাহোমির আমাজনদের সাম্প্রতিক কাহিনী আমরা স্মরণ করতে পারি; তবুও সে-লাঠি ও বন্যপশুর যুগে পুরুষের অধিকতর শক্তি নিশ্চয়ই ছিলো প্রচণ্ডভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নারী যতোই শক্তিশালী হোক-না-কেনো বিরূপ বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তার প্রজননের দাসত্ব ছিলো একটা ভয়ানক প্রতিবন্ধকতা। গর্ভধারণ, প্রসব, ও ঋতুস্রাব কমাতে তাদের কাজের সামর্থ্য এবং কখনো কখনো খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্যে তাদের করে তুলতে সম্পূর্ণরূপে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। মানবপ্রজাতির আদি সময়টা ছিলো। অত্যন্ত কঠিন; সহকারী, শিকারী, ও মৎস্যজীবী মানুষেরা জমি থেকে পেতে খুবই সামান্য শস্য, তার জন্যেও লাগতো কঠোর শ্রম; গোষ্ঠির সম্পদের জন্যে জন্ম দিতে হতো বেশি সন্তান; নারীর অতি-উর্বরতা তাকে বিরত রাখতে সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে, যদিও সে অনির্দিষ্ট মাত্রায় সৃষ্টি করতে নতুন চাহিদা। প্রজাতির স্থায়িত্বের জন্যে তাকে দরকার ছিলো, আর সে অতিশয় উদারভাবেই একে স্থায়িত্ব দিয়েছে; তাই পুরুষকেই ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হয়েছে প্রজনন ও উৎপাদনের মধ্যে। এমনকি সে-সময়েও যখন মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিলো সন্তান জন্মদান, যখন মাতৃত্ব ছিলো খুবই ভক্তির ব্যাপার, তখনও দৈহিক শ্রমই ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আর নারীদের কখনো প্রথম স্থানটি নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় নি। আদিম যাযাবরদের কোনো স্থায়ী সম্পত্তি বা এলাকা ছিলো না, তাই উত্তরপুরুষের জন্যেও কিছু সংরক্ষণের কথা তারা ভাবে নি; সন্তান তাদের কাছে মূল্যবান সম্পদ ছিলো না, ছিলো বোঝা। শিশুহত্যা সাধারণ ঘটনা ছিলো যাযাবরদের মধ্যে, এবং বহু নবজাতক, যারা হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যেতো, মারা যেতো যত্নের অভাবে।
তাই যে-নারী জন্ম দিতো, সে বোধ করতো না সৃষ্টির গৌরব; সে নিজেকে মনে করতো দুর্বোধ্য শক্তিরাশির খেলার পুতুল এবং সন্তানপ্রসবের যন্ত্রণাদায়ক অগ্নিপরীক্ষাকে তার মনে হতো এক অপ্রয়োজনীয় বা বিঘ্নকর দুর্ঘটনা। সন্তানপ্রসব ও স্তন্যদান কর্ম নয়, এগুলো প্রাকৃতিক কাজ; এতে কোনো পরিকল্পনা নেই; এজন্যেই। নারী এতে নিজের অস্তিত্বকে সগৌরবে ঘোষণার কোনো কারণ দেখে নি–অক্রিয়ভাবে সে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে তার জৈবিক নিয়তির। মাতৃত্বের সাথে মেলানো। সম্ভব বলে তার ভাগ্যে পড়েছে গৃহস্থালির কাজ, যা তাকে বন্দী করে ফেলেছে। পুনরাবৃত্তি ও সীমাবদ্ধতায়। এগুলো পুনরাবৃত্ত হয় দিনের পর দিন একই রূপে, যা অপরিবর্তিতরূপে চলেছে শতাব্দীপরম্পরায়; এগুলো নতুন কিছুই সৃষ্টি করে নি।
পুরুষের ব্যাপারটি মৌলভাবে ভিন্ন; সে রক্ষা করেছে নিজের দলকে, শ্রমিক মৌমাছির মতো জৈবপ্রক্রিয়ায় সরল জৈবিক আচরণ দিয়ে নয়, বরং সে-সব কর্ম দিয়ে, যা অতিক্রম করে গেছে তার পাশব স্বভাব। সময়ের আদি থেকে হোমো
ফাবের হচ্ছে আবিষ্কারক : ফল পাড়া ও পশু বধের জন্যে যে-লাঠি ও গদা দিয়ে সে নিজেকে অস্ত্রসজ্জিত করেছে, তাই পরে হয়ে উঠেছে বিশ্বের ওপর তার অধিকার বিস্তারের হাতিয়ার। সমুদ্রে সে যে-মাছ ধরেছে, তা বাড়িতে নিয়ে আসার মধ্যেই সে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে নি : প্রথমে তাকে জলের রাজ্য জয় করার জন্যে গাছের গুঁড়ি খুঁড়ে তৈরি করতে হয়েছে ক্যানো; বিশ্বের সম্পদ লাভের জন্যে সে অধিকার করেছে বিশ্বটিকেই। এসব কাজের মধ্যে সে পরখ করে নিয়েছে তার শক্তি; সে স্থির করেছে লক্ষ্য এবং তৈরি করেছে সেখানে পৌঁছোনোর পথ; সংক্ষেপে, অস্তিত্বশীল হিশেবে সে লাভ করেছে আত্মসিদ্ধি। রক্ষা করার জন্যে সে সৃষ্টি করেছে; সে বর্তমানকে ভেঙেচুরে বেরিয়ে গেছে, সে খুলেছে ভবিষ্যৎকে। এ-কারণেই মাছধরা ও শিকারের অভিযানগুলোর ছিলো পবিত্র চরিত্র। তাদের সাফল্য উদযাপিত হতো উৎসব ও বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে, এবং এভাবে পুরুষ স্বীকৃতি দিয়েছে তার মানবিক গুণকে। আজো সে তার এ-গর্ব প্রকাশ করে যখন সে নির্মাণ করে একটি বাঁধ বা একটি আকাশচুম্বি অট্টালিকা বা একটি আণবিক চুল্লি। সে শুধু বিশ্বকে যেভাবে পেয়েছে সেভাবে রাখার জন্যে কাজ করে নি; সে সীমা ভেঙে বেরিয়ে গেছে, সে ভিত্তি স্থাপন করেছে নতুন ভবিষ্যতের।